ভারতের শস্যভাণ্ডার খ্যাত পাঞ্জাব রাজ্যে শিখ ধর্মবিশ্বাস ও দর্শনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৫শ' বছরেরও বেশি সময় আগে। দেশটিতে প্রায় দুই কোটির পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শিখ সম্প্রদায়ের বাস কানাডায়, সংখ্যায় প্রায় আট লাখ।
কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যায় ভারত সরকারের সম্পৃক্ততার অভিযোগে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। এর জেরে কানাডায় অবস্থানরত শিক্ষার্থী ও প্রবাসী ভারতীয় এবং ভারতে তাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। দুই দেশের প্রতি উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
কানাডায় অবস্থানরত প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে একজন জানান, কানাডায় সামনেই নির্বাচন, আর দুই দেশের কূটনীতিতে ফাটল ধরছে। কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। এসব ঠিক নয়। এতে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হতে পারে। সন্তান, বাবা-মা সবাই চিন্তিত। এমনিতেই আমাদের সন্তানরা কাজ পাচ্ছে না, কোনো সুযোগ পাচ্ছে না, নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
স্বজনদের মধ্যে একজন জানান, সন্তানরা আমাদের থেকে অনেক দূরে, কানাডায় থাকে। কী কী সমস্যায় তাদের পড়তে হচ্ছে, সারাক্ষণ সে চিন্তা ঘিরে থাকে আমাদের। ভয় হয়।
ভারত থেকে আলাদা হয়ে খালিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে কাজ করছেন কানাডায় বসবাসরত শিখদের একাংশ। খালিস্তানপন্থী শিখ নেতাদের ভারতীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে নিয়ে তাদের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা দিয়ে থাকে নয়াদিল্লি। এমন পরিস্থিতিতে কানাডার টরোন্টোতে ভারতীয় দূতাবাস বন্ধের দাবিতে (শুক্রবার, অক্টেবর) সেখানে বিক্ষোভ করেন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একাংশ।
বিক্ষোভে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে একজন জানান, কানাডার সার্বভৌমত্ব, এদেশের বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি ভারতকে আমরা হুমকি বলে মনে করি। কানাডার সব নাগরিকের জন্যই ভারত হুমকি। স্থায়ীভাবে এসব দূতাবাস না সরানো পর্যন্ত আমরা থামবো না।
আরও একজন জানান, কানাডা সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও সহিংসতা অব্যাহত থাকবে বলেই আমাদের ধারণা। কানাডা সঠিক ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাই নিয়েছে। আমরা শুধু চাই এসব পদক্ষেপকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে এবং স্থায়ীভাবে এসব দূতাবাস বন্ধ করতে।
গত বছর জুনে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে শহরে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর। হত্যাচেষ্টার শিকার হন তার বন্ধু মনিন্দর সিংও। কানাডা সরকার এ ঘটনায় সরাসরি ভারত সরকারের দিকে আঙুল তুললেও অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভারত সরকার দাবি করে, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে কানাডা।
কানাডার নাগরিকদের মধ্যে একজন জানান, ভারত সরকারের এটাই জাতীয় নীতি। তারা রাজনৈতিক মতবিরোধে বিশ্বাস করে না। ১৯৮৪ সালের পর থেকে সবসময় আর ১৯৮৪ সালে শিখ গণহত্যার আগেও যেকোনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক বিরোধিতা তারা দমন করেছে সহিংসতা দিয়ে। একই কাজ এখানেও করছে।
এটা কোনো কূটনৈতিক ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি নয়। কানাডার মতো একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ দেশে নিজেদের স্বৈরাচারী মূল্যবোধ আরোপের চেষ্টা এটি।
গুপ্তচর দিয়ে নিজ্জর হত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে ভারতের ছয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের পর দেশটিতে রয়ে যাওয়া বাকি কূটনীতিকদেরও সতর্ক করেছে অটোয়া। কানাডার মাটিতে নতুন করে কারও জীবন বিপন্নের কারণ না হতেও ভারতীয় কূটনীতিকদের হুঁশিয়ার করার কথা জানিয়েছে ট্রুডো প্রশাসন।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাতে ১৯৮৪ সালের জুনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী অপারেশন ব্লু স্টারে প্রাণ যায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের, যাদের বেশিরভাগই শিখ। ওই বছরই নিজের শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা, যার ধারাবাহিকতায় মাসব্যাপী শিখবিরোধী দাঙ্গায় বেসরকারি হিসেবে প্রাণ যায় ৮ থেকে ১৭ হাজার শিখের।