তবে ভাষা আন্দোলন যে শুধু বাংলাদেশে হয়েছে তা নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বত্বন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের উপলক্ষ্য ছিলো ভাষা।
বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার এক গল্প রচনা করেছিলো বাঙালি জাতি। পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য এই ঘটনাকে ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। তবে ভাষার জন্য আন্দোলন ও জীবন উৎসর্গের গল্প বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে রচিত হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয় ১৯৩৭ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সরকার স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। অনশন, সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা, সহিংস প্রতিবাদের মাধ্যমে এ আন্দোলন গড়ায় ৩ বছরে। এরপর কঠোরভাবে এ আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এসময় প্রাণ হারান ২ জন আর নারী-গ্রেফতার করা হয় শিশুসহ ১ হাজার ১৯৮ জনকে। এরপর ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগের পর ১৯৪০ সালে তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষা গ্রহণের আইন প্রত্যাহার করা হয়।
এ আন্দোলনের প্রায় ৩০ বছর পর, ভাষার দাবিতে ভারতে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি হয় ১৯৬৫ সালে। এসময় হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা হলে ২৬ জানুয়ারি দলে দলে রাজপথে নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে মাদ্রাজে প্রায় ২ মাস ধরে চলা সহিংসতায় মৃত্যু হয় শতাধিক মানুষের। প্রতিবাদে ঘটে আত্মাহুতির মতো ঘটনাও। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
মাদ্রাজে যখন ভাষার জন্য আন্দোলন চরমে সেসময় আসামেও হয়েছিলো ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার অহমীয় ভাষাকে আসামের একমাত্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে শুরু হয় আন্দোলন। পরে অবশ্য বাংলাকেও স্বীকৃতি দিয়েছিলো প্রাদেশিক সরকার।
ভাষার জন্য আন্দোলনের গল্প আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটিতে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের ছাত্ররা। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন গাউটাংয়ের জোহানেসবার্গ শহরের সোয়েটোতে শুরু হয় সংগ্রাম। সেসময় শিক্ষার্থীরা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষাগ্রহণে বেশি আগ্রহী ছিলো। কিন্তু আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আফ্রিকানা ভাষায় শিক্ষাপ্রদান বাধ্যতামূলক করলে প্রতিবাদ করে শিক্ষার্থীরা। ইতিহাসে এ ঘটনা সুয়েটা অভ্যুত্থান নামে পরিচিত। তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি করে। শিশু-কিশোরসহ নিহত হয় শতাধিক। ট্র্যাজেডির এই দিনটিকে বলা হয় 'ডে অব চাইল্ড'। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের গল্পে বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্রও। অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা বিলুপ্ত হারিয়েছে। গত ষাট-সত্তরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষার দাবিও সামনে চলে আসে। অবশেষে দীর্ঘ ২০ বছর নানা আলোচনা ও আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদি ও স্থানীয় ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য একটি আইন পাস হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক অঙ্গরাজ্যে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য কমে জায়গা দখল করেছে স্প্যানিশ বা অন্য কোনো ভাষা।
ভাষার প্রশ্নে জাতীয়তাবাদের চরম স্বরূপ দেখিয়েছিলো লাটভিয়ানরা। রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা করার প্রতিবাদে দেশটিতে ২০১২ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। স্পষ্ট ব্যবধানে হারিয়ে রুশ ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেন লাটভিয়ানরা।
এছাড়াও বেলজিয়াম, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইউরোপের বলকান অঞ্চল, এশিয়ার দেশ চীনের ঔপনিবেশিক রাজ্য তাইওয়ান, কানাডার কুইবেক, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলেও ছড়িয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানাভাবে আন্দোলনের উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছিলো এই ভাষা।