১৯০৪ সালের ১৯ ফ্রেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন কার্জন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার পর বিজ্ঞান বিভাগের একটি একাডেমিক ভবনে পরিণত হয় এই হলটি।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ভবন তৈরি করা হতো তা দেখতে যেমন ছিল আকর্ষণীয়, তেমন পরিবেশবান্ধবও ছিল। শ্রেণিকক্ষের দরজা-জানালা এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে গরমের সময় সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে। এতে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্লাস করেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাবির এক শিক্ষার্থী বলেন, 'ক্লাস শেষে আমরা পুকুরপাড় কিংবা গাছের নিচে সুন্দরভাবে বিশ্রাম নিতে পারি। এই যে সবুজ পরিবেশ, খুব ভালো লাগে।'
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অংশে ২০১৩ সালে নির্মাণ করা হয় সামাজিক বিজ্ঞান ভবন। অবকাঠামোগত বেশ আধুনিক এই ভবনে দরজা-জানালা কার্জন হলের মতো নয়। এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিকক্ষে চলে পাঠদান।
আবাসিক হলের বেলায়ও একই চিত্র। বিংশ শতাব্দীর ফজলুল হক মুসলিম হল, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল বা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে রয়েছে অবারিত মাঠ আর সবুজের ছোঁয়া। খেলার পর বিশ্রাম নেয়া যায় গাছের ছায়ায়। তীব্র তাপপ্রবাহে প্রশান্তি দেয় টলমলে পুকুর।
তবে একই জায়গায় ২০০০ সালের পরে তৈরি বিজয় একাত্তর, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি জসিম উদ্দিন হলের চিত্র ভিন্ন। এক জায়গায় থাকা এই চার হলে থাকেন প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার ছাত্র। তবে তাদের খেলাধুলার জন্য আছে মাত্র একটি মাঠ।
ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'চার-পাঁচটা হল অনুযায়ী যদি এখানে দুই-তিনটি মাঠ থাকতো, একইসঙ্গে যদি পুকুর থাকতো তাহলে এই গরমেও আমরা স্বস্তি পেতাম।'
এ তো কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও একইরকম।
৭৫৩ একরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আছে কয়েকটি জলাশয়, খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা রয়েছে। প্রত্যেকটি একাডেমিক ভবনই এমনভাবে বানানো হয়েছে যেখানে আলাদা করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। ক্লাসরুমের চারদিকে গাছপালা থাকায় বাতাস চলাচল করে অবাধে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক বছর আগে দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যতম সুন্দর এই ক্যাম্পাসে গাছের ছায়ায় বসে ক্লাসের ফাঁকে মনের আনন্দে গান গায় শিক্ষার্থীরা।
চারুকলার শিক্ষার্থী শুভ্রা বিশ্বাস, প্রাকৃতিক সব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছেন তার পেন্সিলে। তবে অযত্ন আর অবহেলায় ক্যাম্পাস সৌন্দর্য হারাচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
শুভ্রা ও তার বন্ধুরা গাছের নিচে বসে ছবি আঁকছেন। ছবি: এখন টিভি
শুভ্রা বলেন, 'আশপাশে ময়লা পড়ে আছে। এছাড়া যেখানে-সেখানে তো ময়লা ফেলা হয়। এসব না থাকলে ক্যাম্পাস আরও ভালো দেখাতো।
প্রতি শীতে অতিথি পাখির আগমন জাহাঙ্গীরনগরকে আরও বাড়তি শোভা দেয়। তবে নানা কারণে অতিথি পাখি আসাও কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
এই ক্যাম্পাসে শুধু ভবন দিয়েই শেষ হয়নি। এখানে আছে নানা প্রকারের গাছ। প্রায় ৩৫টি লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন রয়েছে। আবহাওয়াও নাতিশীতোষ্ণ থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে ১৩টি হয়েছে ২০০০ সালের আগে। আর বাকি ৪২টি করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নজর দেয়া হয়েছে শ্রেণিকক্ষের ভবন ও অবকাঠামোগত দিকে। তবে নজর রাখা হয়নি খেলার মাঠ, জলাশয় কিংবা গাছের ছায়ায় বসে শিক্ষার্থীদের বিশ্রাম নেয়ার জায়গাগুলোতে।
এই যেমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ আমলের জগন্নাথ কলেজ ২০০৫ সালে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ নিলেও পরিবর্তন হয় না এর ক্যাম্পাস। সাড়ে সাত একরের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি সুউচ্চ ভবন। একটি ভবনেই কয়েকটি বিভাগের ক্লাস হয়। রাস্তার পাশের এই ভবনটির জন্য ক্লাসরুমে মনোযোগ দিতে পারেন কি শিক্ষার্থীরা?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: এখন টিভি
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হন না। জানান, শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ক্যাম্পাস তৈরির কাজ চলমান আছে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। ছয় তলা মূলভবনের সাথে আছে আরও কয়েকটি ভবন। বড় এই ক্যাম্পাসে কিছু গাছ আছে, তবে তা কি যথেষ্ট? ৫০ একরের এই ক্যাম্পাসে যত্ন নিলে আরও পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
এক শিক্ষার্থী বলেন, 'অনেক পরিত্যক্ত জায়গা আছে। সেখানে বৃক্ষরোপণ করা যায়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ আরও সুন্দর হবে।'
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই চিত্র দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এলাকাভেদে আলাদা আলাদা নকশায় ও ভিন্ন পরিকল্পনায় ক্যাম্পাস তৈরির কথা বলছেন স্থপতিরা।
স্থপতি এ কে এম তানভীর হাসান নীরু বলেন, 'বাংলাদেশে একটি কমন কোড, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যা এলাকাভিত্তিক কোড না। যেকোনো ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিল্ডিং কোড প্রয়োজন। সেটা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় বা মাধ্যমিক স্কুল বা মাদ্রাসা।'
দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। তাই পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে পরিবেশগত দিকগুলোতে শিক্ষার সঙ্গে সমান গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।