ঘুরছে চাকা, উড়ছে বালুকণা। যার সাথে মিশে রয়েছে নানা ধরনের ধুলিকণাও। মেগাসিটি ঢাকার বাতাসে যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় তা আরও কয়েকগুণ বেড়েছে।
আবার কোথাও রাস্তার মধ্যেই চলছে উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞ। যেখানে উন্নয়ন এলাকা আবৃত না করে এলোমেলোভাবে রাস্তা কেটে কাজ করায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। অথচ এসব এলাকা আবৃত করে দিনে কমপক্ষে দুই বার পানি দেয়ার নিয়ম।
রাস্তার ধুলিকণার সাথে পাল্লা দিয়ে অবৈধভাবে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানোর সংখ্যাও বাড়ছে। নিয়ম না থাকলেও শহরের যেখানে সেখানে তা পোড়ানো হচ্ছে। এমনকি আমিনবাজারের সরকারি ভাগাড়েও দিনে দুপুরে বর্জ্য পোড়ানো চলে। যার ফলে বর্জ্যের মধ্যে জমে থাকা মিথেন গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইটভাটার ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ছবি: এখন টিভি
তারপাশেই আবার নীল আকাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে কয়লা ও কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো চলছে। যার ফলে প্রচুর ছাই গিয়ে মিশছে ঢাকার বাতাসে। এর সাথে শিল্প কলকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়াও যোগ হচ্ছে। যা দেশের বায়ুদূষণের অর্ধেকের জন্য দায়ী।
এর পাশাপাশি ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য রাস্তায় চলা অসংখ্য ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোয়া দায়ী ও ট্রান্সবাউন্ডারি এয়ার পলিউশন বা প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা দূষিত বায়ু তো আছেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উৎস থেকে তৈরি হওয়া ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, সীসা, সিলিকন, নাইট্রিক অক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম ও টাইটেনিয়ামসহ নানা ধরনের দূষিত কণা বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। যাতে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে নগরবাসী।
আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের গবেষণা বলছে, বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের নিচে হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। সর্বোচ্চ ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় বলে পরিবেশ অধিদফতর মনে করে। আর এই স্কোর যদি ৩শ' অতিক্রম করে তাহলে তাকে বলা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। যা নগরবাসির জন্য দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশের সমান।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের গবেষণা বলছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১২দিন ঢাকার বায়ুমান ১৫০ মাইক্রোগ্রামের ওপরে ছিল, যা অস্বাস্থ্যকর। ৪৪ দিন ৩শ' এর কাছাকাছি, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং বাকি চারদিন ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪০০ মাইক্রোগ্রামের ওপরে, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ বায়ুমান।
গবেষণা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার গড় বায়ুমান ছিল প্রায় ২০৯ মাইক্রোগ্রাম যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। নির্ধারিত মানমাত্রা থেকে যা প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি।
ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, '২০১৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই আট বছরে আমরা মাত্র ৪৭ দিন নির্মল বায়ু সেবন করেছি। যা এই আট বছরে মাত্র ২ শতাংশ সময়। নির্মল বায়ু নিশ্চিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সাথে সাথে আমরা কত দূষিত বায়ু সেবন করছি সে তথ্যটিও সাধারণ মানুষকে জানাতে পারিনি। এটি এক ধরণের মানবাধিকারের লঙ্ঘন।'
গাড়ির চাকায় ধুলো উড়ছে। ছবি: এখন টিভি
বিভিন্ন গণসেবা প্রতিষ্ঠান বলছে, রাজধানীতে দিন দিন দিনের চেয়ে রাতের বাযু দূষণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে যে বায়ুর সূচক তা রাতে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়েছে। যা দূর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য বলছে, বায়ুদূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এ বায়ু দূষণের জন্য নগরবাসীর গড় আয়ু কমছে প্রায় সাড়ে সাত বছর করে।
রাতে বর্জ্য পোড়ানোর পরিমাণ দিনের চেয়ে আরও বেড়ে যায়। কালো আকাশ যেখানে সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। বাড়ে দূষণের পরিমানও। রাস্তায় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় যা স্পষ্ট দেখা যায়। নগরবাসী বলছেন, রাতে রাস্তায় দূরপাল্লার গাড়ি ও ট্রাক বেড়ে যাওয়ায় দূষণ বাড়ে।
নগরবিদরা বলছেন, নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে দেশে সারা বছরের প্রায় ৫৭ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। এর জন্য তারা সরাসরি দায়ী করছেন পরিবেশ অধিদফতর, সিটি করপোরেশন, রাজউক ও বিল্ডিং কোড অথরিটির উদাসীনতাকে। এই সরকারি সংস্থাগুলো সবাই দায়ী বলে কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনে না বলে দাবি তাদের।
বর্জ্য পোড়ানোর ধোয়া পরিবেশ দূষণ করছে। ছবি: এখন টিভি
নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, 'উন্মুক্তভাবে মালামাল পরিবহন করা ও নির্মাণ কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্প পাসসহ এ বিষয়ে উপযুক্ত বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সরকারিভাবে এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা হয় না। যে বরাদ্দ থাকে তা ভাগবাটোয়ারা ও লুটপাটের একটি ব্যবস্থা হয়। এটি বিভিন্ন সংস্থা পারস্পরিক সহযোগিতায় কেউ কারও উপর দায় চাপাবে না।'
রাজউক বলছে, আইনে যেকোন স্থাপনা নির্মাণের সময় তা আবৃত করার বিধান থাকলেও, না মানলে অভিযুক্তকে জরিমানার বিধান না থাকায় তারা আইন মানাতে বাধ্য করাতে পারছে না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'রাজউক পুরো ২০ হাজার ভবন পরিদর্শন করা, মাত্র ১০০ জন দিয়ে সম্ভব না। ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে সে বিষয়টি বলা আছে যে, আশেপাশে পরিবেশগত কোনো ক্ষতি যেন না হয়। তা অমান্য করলে যে সুস্পষ্ট শাস্তি, তার কোনো বিধান নেই।'
পরিবেশ ও বায়দূষণ বন্ধে দায়িত্ব নেয়ার পরই ১০০ দিনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে পরিবেশমন্ত্রী বলছেন, এবার আর কথায় নয়, কাজ করে দেখাতে চান। সরকারি সংস্থাগুলোকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, 'সরকারি সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালন না করলে এটা একটা উদ্বেগের বিষয়। বালি এবং সিমেন্ট যদি বৈধভাবে নিয়ে আসা হয় তা দেখার দায়িত্ব ডিএমপির। একজন সাধারণ মানুষ এতোজনকে দেখে না। তারা দেখে সরকারকে। সেজন্য আমাদের মধ্যে সে সমন্বয়টা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে যে সমস্যা আমরা ১০ বছরে তৈরি করেছি তা পুরোপুরি সমাধান করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।'
আগামীতে ঢাকাসহ যেকোনো শহরের বায়ুমান খুবই অস্বাস্থ্যকর ও দুর্যোগপূর্ণ হলে, নগরবাসির স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিবেচনায় স্কুল কলেজ ও অফিসের সময় কমিয়ে আনা হবে বলেও জানান পরিবেশমন্ত্রী।