দেশকে মধ্যম আয়ের ফাঁদে ফেলে ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ২০২০ সালে ৬-৯ সুদ হার বাস্তবায়ন করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। আর এই সুযোগে একদিকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে অর্থ লোপাট হয়েছে, অন্যদিকে আমানতে কম লাভে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে অনেক গ্রাহক। এতে ব্যাংকের টাকা কমে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি।
অপরদিকে বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান ধরে রেখে ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে পতিত সরকার এবং তার সহযোগীরা। ফলে তলানিতে নেমেছে রিজার্ভ, বেড়েছে আমদানি খরচ। আর মূল্যস্ফীতি বেড়ে চাপ বাড়িয়েছে সাধারণ মানুষের।
তথ্য বলছে আওয়ামীর ১৫ বছরের লুটপাটের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৭৭ শতাংশের বেশি। ২০০৯ সালের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এ হার গত দেড় দশকে বেড়েছে হয়েছে ১৫ শতাংশে বেশি। এরমধ্যে ক্ষমতায় থেকে মূল্যস্ফীতিকে অনেকটাই কম দেখানো হয়েছে।
তবে রিজার্ভ আর ডলার সংকটের চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তে এ হার কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর শর্ত পূরণে স্মার্ট পদ্ধতিতে ৯-৬ সুদ থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু এরপরও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। ফলে ২০২৪ সালে এ হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৬ বছরের রেকর্ড অর্জন করে।
পরে সংকোচন মূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে কমানোর চেষ্টা করা হয় মূল্যস্ফীতিকে। এতে অর্থ বছরে একবারের বিপরীতে ছয় মাস পর পর প্রকাশ করা হয় মুদ্রানীতি। ফলে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদ হার বাড়ানো সহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয় বেশ কিছু নীতি।
কিন্তু একদিকে অর্থনীতিতে লুটপাট করাতে নানা নীতির ফলেও কমানো সম্ভব হয়নি মূল্যস্ফীতি। তাই বাধ্য হয়েই সুদ হার পুরোপুরি বাজারে ছাড়তে হয়। তবু্ও তার সুফল মেলেনি। কিন্তু কমতে থাকে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর সামনে আসতে শুরু করে অর্থ আত্মসাৎ ও সকল তথ্যের আসল চিত্র। ফলে আরো বাড়ে মূল্যস্ফীতি। তাই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এ হার কমানোর প্রধান লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। যে কারণে কয়েক দফা বাড়ানো হয় সুদ হার। এতে সবশেষ সুদ হার আমানতে ১২ ও ঋণে ১৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
১০ ফেব্রুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার কথা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যা মূল্যস্ফীতি কমানোর মত বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মুদ্রানীতি। জানুয়ারিতে ঘোষণার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতির অবস্থা দেখে এ নীতি প্রকাশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়লে নীতি সুদ আরো ১ থেকে ২ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘উদ্দেশ্যই হচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এবারের মুদ্রানীতিতেও এ বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। সেই সাথে টাকার ভ্যালু যাতে ধরে রাখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ তার ওপর যেন বাড়তি চাপ সৃষ্টি না হয় সবকিছু মাথায় রেখে একটা ব্যালেন্সড মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে আশা করছি।’
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘স্টেট যদি বাড়ায় তাহলে ব্যবসায় খরচ বাড়বে। ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর একধরনের খড়গ নেমে আসবে। আরেকটা যেটা আসবে সেটা হলো আনএমপ্লয়মেন্ট এর হার বাড়বে।’
আবার সুদ হার বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে অন্যান্য নীতি অনুসরণ করতে বলছেন এই বিশেষজ্ঞ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সাময়িক একটা ব্যবস্থা হিসেবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি হয়ত বা করতে হবে। কিন্তু সেটার কারণে বিনিয়োগের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব সেটা অন্যান্য বিষয়ের মাধ্যমে কমাতে হবে। সেখানেই আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশের প্রশ্ন চলে আসে।’
মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রধান হাতিয়ার বলা হয় মুদ্রানীতিকে। তবে এর সাথে রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থায় সঠিক নজরদারির কথা জানান বিশেষজ্ঞরা।
অপরদিকে বিনিয়োগের নামে সুদ হার ধরে রাখায় বড় ক্ষতি হয়েছে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অতীতে আমরা যেটা দেখেছি, সুদের হার চেপে রেখে, ২০২০ এর পর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তাই ছিল। বিনিয়োগে সেটার কোনো প্রকার প্রভাব দেখা যায়নি। যে যুক্তিটা দেয়া হচ্ছে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে বিনিয়োগের দুরবস্থা এটা তো বাস্তবতার সাথে মেলে না।’