৩ যুগ আগে বুড়া গৌরাঙ্গের বুক চিরে জেগে উঠা ভূখন্ড বাসযোগ্য করে ভূমিহীন মানুষরা। নাম হয় তার চর বাংলা। তবে সেটি বেশিদিন বাসের যোগ্য ছিল না। দখলদারদের অত্যাচারে তীর হারায় খেটে খাওয়া মানুষ।
ভূমিহীন একজন বলেন, 'আমার আর আমার স্বামীরে জেলে বন্দী করে ঘর বাড়ি সব লুট করে নিয়ে গেছে।'
আরেকজন বলেন, '৫ থেকে ৬ বার জেল খেটেছি। আমার বাবাও জেলে ছিল। কৃষি জমি আমরা ধান ফলায় দখলদার এসে ধান নিয়ে যায়।'
সিরাজ খাঁর নেতৃত্বেই চর বাংলার ভূমিহীনরা শুরু করে লড়াই। সরকারি দপ্তরের মনগড়া জরিপ আর নিজেদের নায্য অধিকার আদায়ে দারস্থ হন হাইকোর্টের।
ভূমি অফিসের ৮নং রেজিস্ট্রারের ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত সকল জমিই খাস। অথচ যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও এমন অনেক চর খতিয়ানভুক্তই হয়নি। তাতে দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়েও পেরে উঠে না ভূমিহীনরা। হয়ে পড়ে আবাস হীন যাযাবর। জলে ভাসা পদ্ম যেমন।
আরেকজন ভূমিহীন বলেন, 'এখানে থাকার কোনো অবস্থা নেই চারবার বাড়ি করছি চারবারই ভেঙ্গে দিয়েছে।'
পায়রা নদীর উপকূলে কৃষি জমি বালু ভরাট করে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াদুদ খাঁ থেকে জানতে চাই। খাসজমিতে স্থাপনা করছে কারা?
তিনি বলেন, 'যাদের টাকা আছে তারাই এখানে বিল্ডিং করছে।'
সরকারি জমি রক্ষার দায়িত্ব যাদের তাদেরকে দপ্তরে দপ্তরে খুঁজেও দেখা মিললো না। দপ্তর যেন পরিত্যক্ত বাড়ি। জানা গেল, মনের মর্জিতে কর্তা আসেন অফিসে।
তথ্য বলছে, পটুয়াখালী অঞ্চলের আরএস জরিপের কোন মৌজাই সমাপ্ত হয়নি। শুধু বরগুনা কিংবা পটুয়াখালী নয়। বরিশাল বিভাগের সবগুলো জেলাতেই রয়েছে এমন চিত্র। শুধু বরিশাল বিভাগেই রয়েছে ১.৫ লাখ খাস জমি।
দক্ষিণ থেকে এবার যেতে চাই উত্তর জনপদে। এ মাটি রাজকীয়। দোর্দন্ড প্রতাপ আর শাসন শোসনের সমীকরণ এখানকার প্রতিটি ধূলিকনায়। এ মাটির কোষজুড়ে রাজা বাদশাদের স্মৃতিচিহ্ন। ইংরেজ শাসন, পাক শোষণ আর দেশ স্বাধীনের পর অর্পিত সম্পত্তিতে হয়েছে দখলের অলিখীত প্রতিযোগিতা।
ইতিহাসের অন্দরমহলের উত্তর জানালায় কান পাতলেই এই কাচারি ঘরে শোনা যায় এ মাটির শেষ জমিদার ধীরেন্দ্র কান্ত রায়ের কন্ঠস্বর। তবে সময় গড়িয়েছে বহুদূর। হরিয়েছে রাজ্যত্ব, জৌলুসের আঙ্গিনায় এখন মৌনতার মোড়ক।
এ গল্প পুরোটা জানতে হলে, মুখ দেখতে হবে অতীতের আয়নায়। ভিতরবন্দের শেষ জমিদার ধীরেন্দ্র কান্ত রায়ের বাড়ি এটি। আঠারো'শ শতকে নির্মিত কাচারি ঘর থেকে দুই কদম সামনে বাড়ালেই দৃষ্টিজুড়ে ধরা দেয় বিশাল পুকুর। যেখানে কাচারি ঘরের নীরবতা অনুপস্থিত, গায়ের দস্যি ছেলের দলের কাছে রাজার পুকুর যেন জলকেলির জলন্ত উদাহরণ। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু এ যেন রাবীন্দ্রিক ছোগগল্পের মত, শেষ হয়েও হলো না শেষ।
বাড়ি রেখে ভারতে পাড়ি জমান বংশের শেষ অংশিদার প্রতিভা বালা চৌধুরানী। তাতে নামীয় জমি লা ওয়ারিশ হিসেবে ১ নম্বর খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। কিন্তু তার আগেই কয়েক দফা দখল হওয়া এ সম্পত্তির হিসেব গড়ায় উচ্চ আদালতে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফি বলেন, 'এই জমিদারে অনেক সম্পত্তি একটি মহল বিভিন্নভাবে জাল কাগজ তৈরি করে এইসব জমি দখল করে নিয়েছে।'
দেশের উত্তর জনপদের খাস জমির আরেক বড় উৎস ভারতের সঙ্গে বিনিময় হওয়া ১১১টি ছিটমহল। বাংলাদেশ পায় ১৭ হাজার ২৫৮ একর জমি। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়ায় জমির পরিমাণ ১ হাজার ৬৪২ একর। যার মধ্যে ১২৮ একরই খাস জমি। তবে প্রভাবশালীদের দ্বারা এসব জমি দখলের পায়তারার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়া এখানকার বাসিন্দারা।
স্থানীয় একজন বলেন, 'জমি হারানোর বেদনায় আমাদের অন্তরের চোখে প্রতিনিয়ত পানি পড়ছে। কিছুমহল এই জমিগুলো নেয়ার জন্য পায়তারা করছে।'
আরেকজন বলেন, 'একজন কৃষি আবাদ করছে জমিতে আরেকজন এসে বলে এই জমি আমার জমি ছেড়ে দেও কাগজ আমার কাছে আছে।'
রংপুর বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাস জমি কুড়িগ্রাম জেলায় হওয়ায় এ জেলায় যেনো প্রতিযোগিতা চলে সরকারি জমি দখলের। জেলায় প্রায় ৫৫ হাজার একর খাস জমি নিয়ে চলছে, দখলদার ও সরকারের মধ্যে আইনি লড়াই।
রংপুর বিভাগের ১ লাখ ৬২ হাজার একর খাস কৃষি জমির মধ্যে দ্বিতীয় বড় উৎস রংপুর জেলা। এখানে কৃষি উৎপাদন উপযোগী খাস জমি আছে ২৮ হাজার একর। তবে জেলা প্রশাসক বলছেন, এই জমি চলছে বড় পরিকল্পনা।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান বলেন, 'আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কোন জায়গায় কোন খাস জমি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে পারবো সেটা নিয়েই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।'
তবে জমি উদ্ধারের উদাহরণও আছে দেশজুড়ে। বেদখলের ২১ বছর পর পঞ্চগড়ে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ২২ একর খাস জমি। লাল খুটির সীমানা বেষ্টিত এসব জমিতে শোভা পাচ্ছে একটি কুড়ি ও দুটি পাতার নয়নাভিরাম চা বাগান।
উন্নয়ন গবেষক ওমর ফারুক বলেন, 'বিপুল পরিমাণ জমি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যথাযথভাবে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা যায় তাহলে এটি একটি ভালো ফল হয়ে উঠতে পারে।'
শুধু রংপুর কিংবা বরিশাল নয়, সারাদেশের নথিপত্র বলছে, প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে খাস জমি। যার সমষ্টি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার একরের বেশি। যেখানে সবচেয়ে বেশি ২১ লাখ ২৪ হাজার একর চট্রগ্রাম বিভাগে।
তবে এসব হিসেবের বাইরে রয়েছে অসংখ্য জমি। ভূমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংখ্যা ৫০ লাখ একরের কাছাকাছি।
এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, 'এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। এইটার একটা সামগ্রিক ফলাফল কি? সামগ্রিক ফলাফল হচ্ছে ক্রমাগত আমাদের কৃষি জমি কমে যাচ্ছে।'
অথচ সরকারি কোন দপ্তরে একসাথে নেই, সারাদেশের খাস জমির সঠিক পরিসংখ্যান। স্বাধীনতার পর শতভাগ শেষ হয়নি কোন জরিপ। এমন বাস্তবতায় কি ভাবছে সরকারের উচ্চ মহল?
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ বলেন, '২০১২ সালে আমরা ডিজিটাল জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এতে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল আর্থিক ও জনবলের সীমাবদ্ধতা। এই কারণে আমরা এইটা শেষ করতে পারিনি।'
ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র বলেন, '১৮০ দিনে একটা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এই ১৮০ দিনের ভিতর খাস জমি উদ্ধার করার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছি। জমি উদ্ধারের জন্য একটা আইন করা হচ্ছে যাতে এইটা বন্ধ করা যেতে পারে।'
খাস জমি উদ্ধারে শুরুতেই চিহ্নিত করতে হবে দখলদারদের আইনি কুট কৌশল। সংশোধন করতে হবে খাস জমি বন্দবস্ত নীতিমালা। ভূমিহীনদের অধিকার সচেতনের পাশাপাশি করতে হবে মাঠ পর্যায়ের জনবলকে দক্ষ করে তোলা। তাতেই নায্য অধিকার পাবে ভূমিহীন মানুষ আর কমে সমাজে বৈষম্য।