১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনী নিয়ে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘দ্য ম্যাসেজ’। ৩ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন সিরীয়-মার্কিন পরিচালক মুস্তফা আক্কাদ।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামের ইতিহাস অবিকৃতভাবে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে যে অল্প সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘দ্য ম্যাসেজ’।
মুস্তফা আক্কাদ নিজে আরব মুসলমান, কিন্তু জীবন কাটিয়েছেন পশ্চিমা বিশ্বে। তাই তিনি সব সময়ই মনে করতেন, পশ্চিমা বিশ্বকে ইসলামের সত্যিকার রূপ সম্পর্কে জানানো তার কর্তব্য। শুধু মহানবীকে (স.) নয়, আক্কাদ আরেক মুসলিম বীর যোদ্ধা, ইতালীয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লিবিয়ার মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ওমর আল-মুখতারকে নিয়েও ‘লায়ন অব দ্য ডেজার্ট‘ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
সেসময় ধর্মীয় মূলভাবের চলচ্চিত্র তৈরির জন্য অর্থ জোগাড় করা ছিল কঠিন। ‘দ্য ম্যাসেজ’ নির্মাণ শুরুর আগে মুস্তফা আক্কাদ যখন প্রথমবার অর্থ সংগ্রহের জন্য লিবিয়াতে যান, তখন তাকে প্রবেশই করতে দেওয়া হয় নি। এয়ারপোর্ট থেকেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো হয়।
পরবর্তী সময়ে তিনি কুয়েত এবং মরক্কোর কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়ে চলচ্চিত্রটির নির্মাণ শুরু করেন। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতে মরক্কো এবং কুয়েত প্রাথমিকভাবে অর্থায়ন করলেও পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব আপত্তি জানালে কুয়েত তার অবস্থান থেকে সরে আসে।
মরক্কোর রাজা দ্বিতীয় হাসান তারপরও তার সমর্থন অব্যাহত রাখেন। কিন্তু সৌদি আরবের প্রচণ্ড চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত তিনিও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন।
৬ মাস চলার পর মরক্কো ‘দ্য ম্যাসেজ’-এর শ্যুটিং বন্ধ করা এবং মুস্তফা আক্কাদকে প্রথমে গ্রেপ্তার ও পরে মরক্কো থেকে বহিষ্কার করা হয়। অর্থাভাবে বিদেশি কলাকুশলীসহ পুরো ইউনিট শীতাতপ নিয়ন্ত্রণবিহীন নিম্নমানের একটি হোটেলে দিন অতিবাহিত করতে থাকে।
উপায় নেই দেখে আক্কাদ আবারও লিবিয়াতে যান এবং ৬ মাস ধরে মরক্কোতে শ্যুটিং করা দৃশ্যগুলো লিবীয় নেতা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে দেখান।
পিপল ম্যাগাজিনের তথ্যানুযায়ী, গাদ্দাফি ধারণকৃত দৃশ্যগুলো দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং আবেগে কেঁদে ফেলেন। তিনি মুস্তফা আক্কাদকে সিনেমাটির বাকি অংশ লিবিয়াতে নির্মাণের অনুমিত দেন এবং চলচ্চিত্রটি নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য বাকি অর্থের জোগান দেন।
বদরের যুদ্ধে যে বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত অভিনেতার প্রয়োজন ছিল, তার জন্য গাদ্দাফি লিবিয়ান সেনাবাহিনীর ৩ হাজার সৈন্যকে নিযুক্ত করেন। এই সৈন্যরা অভিনয় ছাড়াও সিনেমার সেট নির্মাণেও সাহায্য করেছিল। এছাড়াও গাদ্দাফির সরকার এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের প্রত্যেককে লিবিয়ান মুদ্রায় তাদের মূল পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ পারিশ্রমিক প্রদান করে।
অবশেষে গাদ্দাফির অর্থায়নে ও লিবিয়ান সেনাবাহিনীর সহায়তায়, লিবিয়ার দক্ষিণের মরুময় সাবহা শহরে ৬ মাস শ্যুটিং চলার পর সম্পন্ন হয় ‘দ্য ম্যাসেজ’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ। আরব বিশ্বে ক্লাসিক সিনেমার মর্যাদা লাভ করে এটি। ইসলামিক সিনেমার তালিকায় সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জায়গা দখল করে আছে ‘দ্য ম্যাসেজ’।
দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ইতালিয়ান সেনা ঘাঁটি উচ্ছেদ করে এবং লিবিয়ার তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করে, লিবিয়াকে তিনি পরিণত করেছিলেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রে।
২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ছোঁয়া লিবিয়াতে লাগার পরে আরব রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাসঘাতকতায় এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ষড়যন্ত্রে লিবিয়ার বিপ্লব রূপ নেয় সহিংস গৃহযুদ্ধে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর, বিদ্রোহীদের হাতে পরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবর্ণনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়।
গাদ্দাফি কন্যা আয়েশা গাদ্দাফি মস্কোতে বাবার স্মৃতিচারণ করে চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। প্রদর্শনীতে আয়েশা গাদ্দাফির আঁকা সব চিত্র স্থান পায়।
একটি ছবিতে দেখা যায়, তার বাবা এবং ভাইয়ের মৃতদেহ রক্তাক্ত চাদরে আবৃত, যাদেরকে ২০১১ সালে হত্যা করা হয়েছিল। লাশের পাশেই কিছু লোকের ভিড়। লাশের ছবি তোলার জন্য সবাই স্মার্টফোন হাতে ব্যস্ত। সবার মাথার উপরে ডলার হাতে বিশাল একটি হাতের মুঠি। যেন ডলারের কাছে সবাই একেকটা পাপেট!
আয়েশা গাদ্দাফি বলেন, ‘প্রতিটি ছবিই আমার হৃদয় দিয়ে আঁকা।’
২০১১ সালে বিদ্রোহের সময় আয়েশা গাদ্দাফি লিবিয়া থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রাথমিকভাবে আলজেরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তার পিতার শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের কারণে আলজেরিয়ায় উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে তিনি ২০১৩ সালে ওমানে স্থানান্তরিত হন।