ফিরে দেখা ২০২৫: যুদ্ধ সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছিলো অস্থিরতা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি | ছবি: সংগৃহীত
0

আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালেও অস্থির ছিল মধ্যপ্রাচ্য। মানবিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পরও ইসরাইলের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ফিলিস্তিনিরা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও তা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। বছরের মাঝামাঝিতে ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে সংঘর্ষে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্রও। তেহরানের পরমাণু স্থাপনায় প্রথমবারের মতো বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করে ওয়াশিংটন। আর শেষদিকে এসে লোহিত সাগরের পরিস্থিতি শান্ত হলেও লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়ায় থেমে থেমে উত্তেজনা চলছেই।

গেল এক বছরে বিশ্ববাসী ক্ষমতার উত্থান-পতন, বিরোধ-মীমাংসা, দুর্যোগ-সম্ভাবনা- নানা পরিবর্তনের সাক্ষী হলেও এখনও মুহুর্মুহু বোমায় কাঁপে মধ্যপ্রাচ্য। ২ বছরেরও বেশি সময় আগে যে সংঘাতের সূত্রপাত। সেই আগুনে আজও পুড়ছে মধ্যপ্রাচ্য।

গাজা

বঞ্চনা আর নিপীড়নের মধ্যে আরও একটি বছর পাড় করেছেন গাজাবাসী। তবে ২০২৫ সাল কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে তাদের মধ্যে। এক বছরেও বেশি সময় যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় গেল ১৯শে জানুয়ারি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এসময় জিম্মি ও বন্দি বিনিময় করে উভয়পক্ষ। শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ কার্যকরের পরোক্ষ আলোচনা।

তবে এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়নি। ১৮ মার্চ থেকে আবারও গাজাজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। এসময়, নেৎজারিম করিডোরের পূর্ব অংশ পুনরায় দখল এবং গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয় আইডিএফ। বিপরীতে ৬ এপ্রিল দক্ষিণ ইসরাইলে ১০টি রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। ২০২৪ সালের অক্টোবরের পর ইসরাইলি ভূখণ্ডে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় রকেট হামলা।

২৭ জুলাই আল-মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ এবং গাজা সিটিতে কিছু সময়ের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধের ঘোষণা দেয় ইসরাইল। কিন্তু আগস্টে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় ইসরাইলি সেনারা। প্রাণ যায় অন্তত ১৩ জনের।

১০ অক্টোবর ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসেবে হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর অংশ হিসেবে জীবিত সব জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের রেহাই করার পাশাপাশি গাজার কিছু অংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে আইডিএফ।

আরও পড়ুন:

পশ্চিম তীর

এদিকে ২০২৫ সালে পশ্চিম তীরে সহিংসতা বাড়ে ১৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারির পর নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর দেখেছে পশ্চিমতীরবাসী।

ইরান

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ইরানের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করে। ধস নামে মুদ্রায়। লোহিত সাগরে হুথিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় মার্চে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি আরও জোরদার করার হুমকি দেয়। মে মাসে ইরানের বেশ কিছু তেল শোধনাগারে রহস্যজনক সাইবার হামলা ঘটে, যার পেছনে ইসরাইলকে দায়ী করে তেহরান।

জুনে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা। এরজেরে ১৩ জুন ইরানের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি সংঘাতে জড়ায় ইসরাইল।

ইরানের ২৭টি প্রদেশের অন্তত ১৫০টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ২শ'র বেশি বিমান নিয়ে হামলা চালায় আইডিএফ। ঐদিনই অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি নামে তেল আবিবে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান। ১২ দিন ধরে চলে সে সংঘাত, ২৪ জুন ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এরমধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ২১ জুন B-2 স্টিলথ বোম্বার ব্যবহার করে ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ, ইস্পাহান পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে মার্কিন বিমান বাহিনী। প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় বাঙ্কার বাস্টার বোমাও।

আরও পড়ুন:

লেবানন

২০২৪ এর নভেম্বরে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি ভেঙ্গে জানুয়ারিতে লেবাননে আবারও হামলা শুরু করে ইসরাইল। জবাবে, ২২ ও ২৮ মার্চ ইসরাইলে পাল্টা রকেট হামলা চালায় লেবানন। অন্যদিকে, ফেব্রুয়ারিতে লেবাননের পশ্চিম সীমান্তে সিরীয় সেনাবাহিনী একটি নিরাপত্তা অভিযান শুরু করে। মূলত মাদক, অস্ত্র এবং মানব পাচার রোধে এই অভিযান চালানোর ঘোষণা দিলেও সিরীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং লেবানীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। আগস্টের শুরুতে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণ করতে সেনাবাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব দেয় লেবাননের সরকার।

ইয়েমেন

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ২০২৫ এর জানুয়ারিতে লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজে হামলা বন্ধ করে ইয়েমেনি হুথিরা। তবে, মার্চে হুথিদের লক্ষ্যবস্তুতে তীব্রভাবে বিমান হামলা শুরু করে মার্কিন সেনারা। এসময় হুথিদের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আর গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ায় হুথিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। এপ্রিলে মাসে 'অপারেশন রাফ রাইডার' এর অধীনে ইয়েমেনে হুথি লক্ষ্যবস্তুগুলোতে মার্কিন বিমান হামলার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়।

৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে জুলাইতে আবারও লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে হুথিরা। আগস্টের শেষের দিকে এসে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে পরপর ১০টি হামলা চালায় হুথিরা সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ড পরিমাণ হামলার পর, ১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পরপরই ইসরাইলে ওপর হামলা বন্ধ করে হুথিরা।

সিরিয়া

বাশার আল আসাদের পতন পর সিরিয়া গঠনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আল শারাহ নেতৃত্বাধীন সরকার। সিরিয়ার সামরিক বলয়কে দুর্বল করা এবং তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ জুড়ে সিরীয় ভূখণ্ডে অভিযান শুরু করে ইসরাইল।

১০ মার্চ আহমেদ আল-শারা-এর নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস এর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে, সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো এবং আর-রাক্কা শহরের কাছে সরকারি বাহিনী এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন এসডিএফ এর মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। অক্টোবরে সিরিয়ায় সামগ্রিক সহিংসতা কমলেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বেড়ে যায়।

ইএ