মলিন ধুলোপড়া ভাঙা টেলিফোন। দেখে ফেলনা মনে হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এটির দাম উঠবে ১০০ থেকে ১৫০ ডলার। সাধারণের চোখের কোনো মূল্য না থাকলেও শৌখিন প্রাচীন পণ্য বা অ্যান্টিক সংগ্রহকারীদের কাছে এটি অমূল্য।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডকে ঘিরে পুরোনো আট দশটি দোকান যেন অনন্য জাহাজি পণ্যের বিরাট সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। এসব দোকানে শত বছরের গল্প ফেরি করছে জাহাজের নানা নামফলক, ব্যাজ, যন্ত্রাংশ, গ্রামোফোন, কম্পাসসহ চেনা অচেনা শতাধিক সরঞ্জাম। ভিন্টেজ বা অ্যান্টিক যে নামেই পরিচিত হোক না কেন সৌখিন সংগ্রহকারীদের কাছে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লোহা লক্কড়, নানা ফিটিংস বা সরঞ্জাম তো আছেই। পুরোনো জাহাজগুলো যেন সমুদ্রের সমৃদ্ধ ইতিহাস ফেরি করা প্রাচীন পণ্যের এক অনন্য খনি। যেমন সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাটের এই দোকানে দৃষ্টিনন্দন টেকসই এই ঘড়িটি ৫০ বছরের ইতিহাস ফেরি করছে। এখানে মিলবে এমন গ্রামোফোন, টেলিস্কোপ, কাঠের হাতলযুক্ত টেলিফোন, ঘড়ি, জাহাজের চাকা, বা কম্পাসের মতো নানা অ্যান্টিক সামগ্রী। পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্র রুটে দাপিয়ে বেড়ানো পুরাতন জাহাজের স্মৃতি মাখা এসব পণ্য দেশিয় বাজার ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে রপ্তানিতেও।
ব্যবসায়ীরা জানান, সেই আশির দশক থেকেই এসব পণ্যের চাহিদাকে মাথায় রেখে মাদাম বিবিরহাট এলাকায় গড়ে উঠে এই ব্যবসা। মূলত রপ্তানিনির্ভর হওয়ায় এখানকার দোকানগুলোতে সাধারণ ক্রেতার উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়েনা। একসময় বিদেশিদের প্রচুর আনাগোনা থাকলেও এখন ই-মেইল আর হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে সেই রীতিতে এসেছে বড় পরিবর্তন।
শিপ ব্রেকিং গবেষক মিজানুর রহমান ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষের কাছে হয়তো এসব পুরোনো জিনিসগুলো লোহা লক্কড় চেয়ে বেশি কিছু না, কিন্তু এ পণ্যগুলোর নিলামের বাজারে দাম ওঠে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কারণ এ পণ্যগুলোর পিছনে রয়েছে কিছু ইতিহাস এবং এগুলো কোনো ঐতিহাসিক শিপের অংশ হতে পারে।’
সমুদ্র পথের বিভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি দেয়া তেলবাহী, কন্টেইনারবাহী, বা যাত্রীবাহী জাহাজের প্রায় অর্ধেকের গন্তব্য বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড উপকূল। যেগুলো ভাঙলে পাওয়া যায় বিচিত্র রকমের সৌখিন ও ইতিহাসভিত্তিক পণ্য। এইসব পণ্য ইয়ার্ড মালিকদের থেকে কিনে নেন ট্রেডাররা।
কে আর শিপ রিসাইক্লিং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘এক একটা জাহাজের বয়স থাকে ২০ থেকে ৩০ বছর । ওই ক্ষেত্রে ৩০ বছর পুরোনো একটা অ্যান্টিক জিনিসপত্র ১০ থেকে ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।’
পুরোনো এসব পণ্যের বাজার শত কোটি টাকার। রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে গত ২ বছর জাহাজের সংখ্যা কমায় রপ্তানিও কমেছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু আমরা এখন ৪০ লাখ টন থেকে ১০ লাখ টন রিসাইক্লিং করি, তাই অ্যান্টিকের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবে কমে এসেছে। তবে আমরা যদি আবারও ৪০ লাখ টন রিসাইক্লিং করতে পারি তাহলে এই অ্যান্টিক পণ্যের বাজার আবার উন্নত হবে। তাই আমি মনে করি, এ সময়টা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং, যেখানে সরকারি নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন হবে।’
গত চার দশকে এখানকার অ্যান্টিক পণ্য ঘিরে জাদুঘর বা তথ্যকেন্দ্র গড়ে উঠা সম্ভব ছিল, এতে অনেক অজানা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করতো জাদুঘরটি।