কৃষি
0

দাদনের ফাঁদে থমকে আছে উপকূলীয় জেলেদের জীবন

দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলীয় জেলে জীবন। সে কারণেই জেলেদের হাত পাততে হয় মহাজনের কাছে। দাদনের মাধ্যমে পেশার শুরু হলেও দুষ্টচক্রে ফেঁসে যান জেলে। অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত নির্দিষ্ট মহাজনের কাছেই স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিকার করা ইলিশ। এতে আড়তদার বা মহাজনের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও জেলে জীবন আটকে যায় দাদনের মারপ্যাঁচে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে সরকারকেই নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসময় নীলচাষিদের অগ্রিম অর্থ প্রদান করে যে দাদন প্রথা চালু করেছিলো সে দাদনের ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত রেখেছে মৎস্য আড়তদার কিংবা মহাজনরা।

উপকূলের লাখো মানুষ জেলে পেশায় জড়িত। যাদের বেশিরভাগই আটকা পড়েছেন দাদনের মারপ্যাঁচে। এই দাদনের ফলে আড়তদাররা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি নতুন নতুন ইলিশের সিন্ডিকেট গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছেন। অপরদিকে জেলেদের জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা।

রূপালী ইলিশের জোগান দিচ্ছেন যারা তাদের জীবনই বর্ণহীন হয় দাদনের মারপ্যাঁচে। সমতলের সাথে জেলেদের দাদন লেনদেনের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে একজন আড়তদার সমুদ্রগামী ট্রলার মালিককে ৫ থেকে ১০ লাখ বা নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাদন হিসেবে দেন।

ট্রলার মালিক আবার সে অর্থ থেকে কিছু অংশ তার ট্রলারের জেলে ও স্টাফদের দাদন হিসেবে দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে দাদনও ঘোরে দু থেকে তিন হাত। তবে, শর্ত থাকে দাদনের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট আড়তেই দিতে হবে মাছ।

অন্যদিকে, নদ নদীতে যে-সব জেলেরা মাছ শিকার করেন তারাও ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা দাদন নিয়ে থাকেন আড়তদার বা মহাজনের কাছ থেকে। সেই টাকায় ট্রলার মেরামত বা নতুন ট্রলার নির্মাণ করে মাছ ধরতে নেমে পড়েন নদ- নদীতে। প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ পান সেগুলো শর্ত অনুযায়ী বিক্রি করতে হয় নিদিষ্ট আড়তদারের কাছের। এক্ষেত্রে, প্রতিবারে মাছের দাম নির্ধারণ করেন আড়তদার, পাশাপাশি কাটেন মোটা দাগে কমিশন। অন্যদিকে দাদনের মূল অংক থাকে স্থির।

এভবেই দাদনের দুষ্টচক্রে জেলেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রতারিত হয়। বঞ্চিত হয় শ্রমের সঠিক মূল্য থেকে। অন্যদিকে আড়তদাররা ইলিশের নতুন নতুন সিন্ডিকেট করে চাহিদা বা যোগানের হেরফের দেখিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ফেলেন বিপাকে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রতি ১০০ জন জেলের মধ্যে ৯৫ জনই দাদন নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৮০ জনই দাদনের মারপ্যাঁচে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। এদের অনেকেই আবার দায় মেটাতে না পেরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পেশা পরিবর্তনের।

দাদনের দুষ্টচক্র থেকে বাঁচার উপায় কী? এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ জানান উপকূলীয় এলাকা বা জেলেদের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পসুদে বা সুদবিহীন ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে এ সংক্রান্ত তহবিলও গঠন করতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. শহিদুল জাহিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বা অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু একটি সার্কুলার জারি করে উপকূল কেন্দ্রিক ব্যাংক ও এনজিওর মাধ্যমে সেসব মৎস্যজীবীদের স্বল্প আকারে আর্থিক সহযোগিতা দিতে পারে। যাতে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই রিফাইন্যান্স করতে পারে।’

বর্তমানে চলছে ইলিশ শিকারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। নদী ও সমুদ্রে টহল হয়েছে জোরদার। এ সময়ে জেলেরা কাটাচ্ছেন বেকার সময়। পরিবারের খরচ মেটাতে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন দাদন নিতে। তবে জেলেদের দুর্ভোগ লাঘবে জেলে কার্ড বা ট্রলারের নিবন্ধনপত্রের বিপরীতে স্বল্পসুদে বা সুদহীন ব্যাংক ঋণের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান মৎস্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসক।

বরগুনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, ‘আমরা জেলেদের স্বাবলম্বী করতে বিনামূল্যে বকনা বাছুর বিতরণ করে থাকি পাশাপাশি ছাগল ও খাবার দিয়ে থাকি যাতে তারা বিকল্প আয় করতে পারে। এছাড়া আমরা নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকি।’

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘দাদন ব্যবস্থার থেকে জেলেদের রক্ষার্থে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যে একটি প্রস্তাব এসেছে। আমরা জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সেই প্রস্তাব পেশ করেছি। আগামীতে আমরা মৎস্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি পেশ করব।’

টেকসই মৎস্য আহরণে দ্রুতই প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ এগিয়ে আসতে হবে নীতি নির্ধারকদের।

এএম