স্বপ্ন ছিল তার সাংবাদিক হবার। সেই পথেই হেঁটেছিলেন আল নাহিয়ান। কাজ করেছেন গণমাধ্যমে, লিখেছেন বইও। অভিনয় করেছেন টিভি নাটকেও। কিন্তু এই স্বপ্ন যে তার দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে উঠবে তা কে জানতো!
পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, রিমান্ড কিংবা আয়নাঘর। গেল দশ বছরে সব জায়গাতেই নেয়া হয়েছে তাকে। কথা বলাই ছিলো অপরাধ। দেয়া হয় মিথ্যা মামলা।
নাহিয়ান বলেন, 'আমি জানতাম না ওইটাকে আয়নাঘর বলা হয়। আমাকে একটা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ৮ দিন রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়।'
শুরুটা হয় ২০১৩ সালে। আল নাহিয়ান তখন একটি সাহিত্য পত্রিকায় কাজ করেন। সে সময় তুমুল আলোচনায় গণজাগরণ মঞ্চ। সে মঞ্চের নেতৃত্বস্থানীয়দের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নেমে আসে ঝড়। আল নাহিয়ানসহ পত্রিকার অফিস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সম্পাদকদের।
তিনি বলেন, 'বিভিন্ন স্থান থেকে গণজাগরণ মঞ্চের কথা বলে প্রকাশক বোরহান মাহমুদ ভাইয়ের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়। চাঁদা না দিলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়।'
তখনই প্রথম পরিচয় হয় আয়নাঘরের সাথে, যদিও জানা ছিলো না এই নামের। চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। নিয়ম করে করা হতো নির্যাতন।
অমানুষিক নির্যাতনে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আল নাহিয়ান। এতে তার পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে আর্থিকভাবে।
তিনি বলেন, ‘আমি মেন্টাল ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। বাসায় কলিংবেল বাজলে মনে হতো পুলিশ আসছে ধরে নিতে।’
টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেলেও মুক্তি পাননি স্থানীয় রাজনৈতিক মোড়লদের হাত থেকে।
পরিবারে ছোট ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বাবার। স্কুল জীবনে কবিতা লিখতেন ইত্তেফাকের কচিকাচার আসরে। মেধাবী নাহিয়ানের প্রশংসা শুনে বাবার বুক ভরে উঠতো গর্বে। কিন্তু সব কিছুই যেন আজ হারানো অতীত।
নাহিয়ানের বাবা বলেন, ‘১০ বছর ধরে চলছে মামলা। কোনোরকম মামলা থেকে মুক্তি পায় না। মামলার তারিখ মতো যেতে হবে। প্রায় সময়ই পুলিশে ডিস্টার্ব করতো।’
দুঃস্বপ্নের ১০টি বছর কাটিয়ে এখন মুক্ত পরিবেশে বাঁচার আশায় বুক বেঁধেছেন নাহিয়ান। তবে তারুণ্যের যে সময়টা হারিয়েছেন, তা কে ফিরিয়ে দেবে?
নাহিয়ান বলেন, ‘এই দশ বছর আমার জীবন থেকে চলে গেল কে ফিরিয়ে দিবে। আমি এর বিচার চাই।’
কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে নাহিয়ানের মতো অসংখ্য তরুণকে শিকার হতে হয়েছে গুমের। জীবন দুর্বিষহ হয়েছে নানা হামলা-মামলায়। কিন্তু এই নিপীড়নের জন্য মিলবে কী কোন ক্ষতিপূরণ?
ঢাবির সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ পরিচালক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন,‘সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন যারা করেছে অবশ্যই তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার না হলে তো মানবাধিকার যারা লঙ্ঘন করছে সেটার তো নজীর স্থাপন হবে না।’
বিচারবহির্ভূত সব গুম বা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবি এসব দুঃস্বপ্নের পথ পাড়ি দেয়া যাত্রীদের।