আকাশের বুকে খুশির চাঁদ মানেই কাজী নজরুল ইসলামের এই কালজয়ী গান। প্রায় শতবছর ধরে মাতিয়ে রেখেছে উৎসব অনুরাগীদের। গানটির মাধ্যমে বাঙালির ঈদুল ফিতরকে অর্থের পূর্ণতা দিয়ে গেছেন বহুদর্শী এই মানব। গানটির বয়স যতখানি বেড়েছে, তার চেয়েও প্রসারিত হয়েছে এর মর্যাদা।
তবে নিজ ইচ্ছেতে এই গান লিখেননি তিনি। সে সময়ের শিল্পী আব্বাসউদ্দীন তার আত্মজীবনীতে তুলে এনেছেন গানটির রচনার মূল প্রেক্ষাপট।
আব্বাসউদ্দীন আহমদের আত্মজীবনী 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' থেকে জানা যায়- নজরুলের সঙ্গে তার বেশ সুসম্পর্ক ছিল। আব্বাসউদ্দিন বয়সে একটু ছোট হলেও দু’জনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতোই। নজরুলকে তিনি ভালোবেসে ডাকতেন কাজীদা।
১৯৩২ সালে মূলত তিনিই ইসলামিক সঙ্গীত লিখার জন্য কাজী নজরুলকে অনুরোধ করেন। এতে নজরুলের জয়গান প্রতিটি মুসলিম পরিবারে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ তখন শ্যামা সংগীতের সুর ও রচনার জন্য তার বেশ খ্যাতি ছিল। অন্যদিকে ইসলামিক কোনো গান গ্রামোফোনে রেকর্ড হতো না।
গ্রামোফোন রিহার্সালের দায়িত্বে থাকা ভগবতী বাবুকেও স্রোতের বিপরীতে গা ভাসাতে রাজি করান আবাসউদ্দীন। অবশ্য এতে সময় লেগে যায় ছয় মাস। তবে এটিতে এক ধরনের শঙ্কা ছিল। দর্শকপ্রিয়তা না পেলে হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে ইসলামিক গানের রেকর্ডিং।
এরপরের গল্পটা শুধুই নজরুলের। পছন্দের চা আর পান খেয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই লিখে ফেললেন অমর এই গান। যা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেও খুব একটা সময় নেয়নি। নজরুল হয়ে উঠেন আরও অসামান্য। গানটিতে প্রথম কণ্ঠও দেন আব্বাসউদ্দীন। গানটির জনপ্রিয়তার কারণে অনেক হিন্দু শিল্পীও মুসলমান নাম ধারণ করে এই গান গাইতে শুরু করে।
ঘরে ঘরে ঈদুল ফিতরের আমেজ শুরু হয় এই গানটি দিয়ে। যা ঈদ উদযাপনকে আরও অর্থপূর্ণ করেছে বলে মত নানা বয়সীদের।
একজন যুবক বলেন, 'গানটা আসলে আমাদের ঈদের সত্ত্বার মধ্যে মিশে গেছে। আমরা এই গানটা ছাড়া ঈদ কল্পনাই করতে পারি না। আগে থেকেই এই সংস্কৃতিটা আমাদের মধ্যে মিশে আছে।'
একজন কিশোরী বলেন, 'এই গানের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে ঈদ কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের ঈদের আনন্দ বেড়ে যায়। চাঁদ রাতে যখন চাঁদ দেখতে পাই, তখন এই গান বাজিয়ে সবাই আনন্দ করি একসাথে।'
কবি নজরুলের অসাধারণ সুরের জ্ঞান এবং ইসলামী দর্শনের কারণেই এই গান কালজয়ী হয়েছে বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম।
তিনি বলেন, 'অসামান্য একটি গান। এই গান এত বিখ্যাত হলো কেন? এই গান এত গৃহীত হলো কেন? ১৯৩২ সালে এই গান প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। এখন ২০২৫ সাল, এই গানের কাছাকাছি গ্রহণযোগ্য কোনো গান কেন হলো না? না হওয়ার কারণ হলো নজরুলের অসামান্য সুরের গান। তার অসামান্য কবিত্ব। এবং ইসলাম সম্পর্কে নজরুলের অসামান্য দার্শনিক এবং ভাবাদর্শীয় উপলব্ধি।'
জাতীয় কবিকে কাফের বলা কিংবা বিদ্রোহী কবিতায় নাস্তিক্যবাদী ভাবধারা থেকে নজরুল এ গান রচনা করেন- এমন ধারণাকেও উড়িয়ে দেন তিনি।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, 'নজরুলের ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী এই ধরনের কোনো তকমা আসলে সর্বজনীনভাবে ছিল না। থাকতে পারেই না। কিন্তু মুসলমান সমাজ নজরুলের বিরোধীতা করেছে বলে একটা কথা মাঝে মাঝে বলা হয়, এটা কিন্তু ডাহা মিথ্যা কথা। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া ছিল। এটা সবসময় সমস্ত লোকের কাছে থাকে।'
ঈদ আসে ঈদ যায়, রয়ে যায় কেবল কবি নজরুলের অনবদ্য এই সৃষ্টি। যা প্রতিবছরই স্রোতাদের মনে নতুন রূপে দাগ কাটে। একাধারে ধর্মীয় সঙ্গীত সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের মহার্ঘ্য এক সম্পদ। আবার সাহিত্য দর্শনের পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম কবি নজরুলকে সর্বাঙ্গে পূর্ণতাও দিয়েছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন কবি নজরুল অনুরাগ কিংবা অনুচিত্তের সাথে যে পরিমাণ হামদ-নাত লিখেছেন তার ধারেকাছেও কেউ নেই। যা ধর্মীয় চর্চায়ও ব্যাপক প্রসার ঘটাতে সক্ষম।