স্বাস্থ্য
দেশে এখন
0

জনবল সংকটে ধুকছে হবিগঞ্জের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো

দেশের জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। যেখানে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সেবা প্রদান করছেন। গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন্য এসব সেবা সুবিধাজনক হলেও, এর ব্যয় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর পক্ষে তা গ্রহণ করা কঠিন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা এই সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হন।

তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র চালু করেছে। এসব কেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে মা ও শিশুদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, ওষুধ সরবরাহসহ নানা ধরনের সেবা দেয়া হয়। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

এই যেমন মাধবপুর উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটি সীমান্তবর্তী প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জন্য একমাত্র ভরসার স্থান। কিন্তু এখানে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন মাত্র একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা।

কেন্দ্রটির পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা রোকসানা আক্তার বলেন, 'প্রতিদিন আমার এখানে প্রচুর সংখ্যক রোগী আসে। কিন্তু আমি একা তাদের সেবা দিতে পারি না। ডেলিভারির রোগী যেদিন আসে সেদিন আর কোনো রোগীর সাথে কথা বলারও সুযোগ হয় না। এছাড়া ডেলিভারি কাজেও তো আমাকে সহযোগিতা করার জন্য একজন দরকার। সেটাও নেই।'

হবিগঞ্জ জেলায় মোট ৫২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসবে অবদান রাখছে। যেখানে প্রাইভেট হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের সিজারে উদ্বুদ্ধ করা হয়, সেখানে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে শতভাগ স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে।

২০২২ সালে হবিগঞ্জ জেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে আট হাজার ৭৩৭টি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল আট হাজার ৮১৬ এবং ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত হয়েছে দুই হাজার ১৬১টি স্বাভাবিক প্রসব।

এসব কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, জনবল সংকট না থাকলে এর পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হতো।

জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের তথ্য বলছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রে ছয়টি পদে অন্তত ১০ জন জনবল থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি ভিন্ন। অধিকাংশ কেন্দ্র মাত্র এক থেকে দুই জন কর্মী দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

জেলায় মোট উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের ৫২টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১০ জন, ফার্মাসিস্ট ১৩ জনের স্থলে তিন জন, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার ১০১টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ৬০ জন, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা ৭৮ জনের মধ্যে ৭৩ জন, এমএলএস বা নিরাপত্তা প্রহরী ৫২ জনের স্থলে ১৮ জন, আয়া ৮১ জনের বিপরীতে ৫৪ জন। এর মধ্যে কেউ কেউ একটি কেন্দ্রে পদায়ন থাকলেও দ্বায়িত্ব পালন করছে উপজেলা কিংবা জেলা পর্যায়ে। কেউ আছেন ছুটিতে। ফলে জনবল সংকটের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

চৌমুহনী ইউনিয়নের বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, 'আমরা এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি। তবে জনবল সংকটের কারণে সবসময় সেবা পাওয়া যায় না। এখানে কোনো ডাক্তার নেই। একজন মহিলা শুধু অঅছেন। তিনি কি চিকিৎসা করবেন? এছাড়া অধিকাংশ সময়ই আসলে তিনি বলেন ওষুধ নাই।'

পইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নুরজাহান বেগম বলেন, 'আমার এই কেন্দ্রটিতে যে পরিমাণ সেবা প্রতিদিন দিতে হয়, সেই তুলনায় জনবল খুবই কম। এখানে অন্তত দু'জন ভিজিটর দরকার। ২৪ ঘণ্টা ডেলিভারি সেবা দেয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যায়। কারণ একজন ডেলিভারি রোগী যখন আসে, তখন তাকে রেখে এক মিনিটের জন্য দূরে যাওয়া যায় না।'

লুকড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে আসছেন মনিহার বেগম নামে এক নারী। তিনি বলেন, 'ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট চাইছি, কয় নাই। শুধু প্যারাসিটামল দিয়েছে। আমরা গরিব মানুষ, এখানে যদি চিকিৎসা পাইতাম, তাহলে উপকার হইত। কিন্তু ওষুধ নাই, ডাক্তার নাই।'

জনবল সংকটের বিষয়ে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'কিছুদিন আগে একটা সার্কুলার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। ফলে নতুন জনবল নিয়োগ আটকে গেছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা যতটুকু পারছি সীমিত জনবল দিয়ে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে এই সংকট দ্রুত সমাধান করা না গেলে সেবার মান আরও খারাপ হতে পারে। যে কারণে মন্ত্রণালয়কে দ্রুত নিয়োগের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া দরকার।'

এসএস