জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানের দোসররা দেশের হাজারো বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে তাদের আত্মত্যাগ আর স্বপ্নের বাস্তবায়নে রয়ে গেছে ঘাটতি।
সবুজ সার্বভৌম ভূমি হবে পূর্ববাংলার মানুষের। এই স্বপ্নের সহযাত্রী ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাজীবীরাও। কিন্তু সর্বকণ্ঠে বিজয়ের গান গাওয়ার আগেই, পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এই আলোকিত মানুষদের হত্যা করে বিজয় লগ্নের আগমূহুর্তে।
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ নিয়ে আসে আঁধারের দিন। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর চিন্তার প্রসারতাকে রুদ্ধ করে দিতে জেনারেল রাও ফারমান আর এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার বাস্তবায়ন করা হয়।
মুক্তিকামী বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করতেই সোচ্চার ছিলেন এদেশের বুদ্ধিজীবীরা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নানা নিপীড়ন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলিত করেছিলেন বাংলার জনগণকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগ মূহুর্তেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তারা। জাতিকে মেধাশূণ্য ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা নিঃশেষ করে দিতেই সামরিক জান্তাবাহিনী চালায় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানরা বলছেন, তাদের রেখে যাওয়া আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারলেই পূর্ণতা পাবে এই আত্মত্যাগ।
ক্ষত-বিক্ষত লাশ ফেলে রাখা হয় রায়েরবাজার, মিরপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায়। সেদিন অনেকেই হয়েছিলেন নিখোঁজ।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা
বাংলাপিডিয়ার হিসাব অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশজুড়ে প্রায় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর বাহিনী। এদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন শিল্পী-সাহিত্যিক, ৫ জন প্রকৌশলী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবী ছিলেন ৭ জন।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে মিলেছে একটি স্বাধীন ভূখন্ড। এই শূন্যতার মাঝেই বিজয়ের পূর্ণতা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে কতটা পূর্ণতা পেয়েছে রাষ্ট্র? এমন প্রশ্নে আক্ষেপটা রয়েই গেছে। আপোষহীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার খাতা যেন আজও শূন্যতায় ভুগছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজউদ্দিন হোসেনের সন্তান জাহীদ রেজা নূর বলেন, 'রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে পাশাপাশি চালানোর যে ক্ষমতাটা ছিল সেটা তারা করেছেন। কারণ সেসময় আমাদের বাঙালিদের মাঝে আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠেনি, সেনাবাহিনী সেভাবে গড়ে ওঠেনি, ব্যবসায়ী সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার্থীরা অনুপ্রেরণাটা পেতেন এই বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে।'
তিনি আরও বলেন, 'যে শূণ্যতাটা এসেছে সেটা হচ্ছে যারা বেঁচে ছিলেন এবং যারা তাদের সেই কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন তারা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আগামী প্রজন্মকে এর সংলগ্ন করতে হবে।'
স্বাধীনতা পরবর্তী ৭২'র সংবিধানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটেছিল আংশিক। তবে তা কলুষিত হয়েছে বারবার। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবেও হচ্ছে না বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গবেষণা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অবদানকে নতুন প্রজন্মের মাঝে আরও বিস্তৃত করার দাবি স্বজনদের ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর বলেন, 'সবকিছু আমরা বাস্তবায়নের জায়গায় আল্টিমেটলি যেতে পারিনি। সেটা যদি বলি, ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়। তো সেখানে আমার মনে হয় একটা মিশ্র অনুভূতির জায়গা আছে। আগের জায়গাটাকে কিছুটা পেছনে ফেলে বা সেটাকে কাজে না লাগিয়ে আমরা সামনের দিকে আগাচ্ছি। সেটা আমাদের হাতড়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমাদের হাতড়ে বেড়াতে হয়ত হতো না বা হবে না আমরা যদি কিছুটা সেসময়কার চিন্তাভাবনাগুলোকে, দর্শনগুলোকে একটু পড়ার চেষ্টা করি, জানার চেষ্টা করি এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করি।'
৪৭'র দেশভাগ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ-যুগে যুগে আন্দোলনের নেপথ্যে অগ্রসরমূলক ভূমিকা ছিল বুদ্ধিজীবীদের। শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মীরা প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে প্রগাঢ় মেধা-মননশীলতায় এগিয়ে নিতে চেয়েছেন দেশকে। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যয়, চিন্তা যেন হয় নিঃস্বার্থ, আপোষহীন আর দলমতের ঊর্ধ্বে। এমন আশাবাদ চিন্তাবিদদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, 'এখানকার যারা লেখক শিল্পী ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, অনেক সাংবাদিক ছিলেন। তাদের একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবীরাও চলে গেছেন ভারতে। এবং ভারতে থেকেও তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু কিছু কাজ করেছেন।'
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বুদ্ধিজীবীদের যে গৌরবময় আত্মত্যাগ তা চির সমুজ্জ্বল। রবি ঠাকুরের ভাষায় তাই বলা যায়, 'মরণসাগর পারে তোমরা অমর, তোমাদের স্মরি।'