যে শহরের নাম শুনলে রসমালাইয়ের মুখরোচক ছবি কল্পনায় ভেসে উঠে সেটি কুমিল্লা। রানী ময়নামতি, ভিক্টোরিয়া আর ধর্মমানিক্যের ধারাবাহিকতায় এ শহর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, উপমহাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী শচীন দেব বর্মন, ব্রিটিশবিরোধী গেরিলা আন্দোলনের দুঃসাহসী ছাত্রী শান্তি- সূনীতির। ১২৫বছর পৌরসভার বয়সকালে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয় দেশের প্রাচীন এ শহর। সমতটের গুরুত্বপূর্ণে এ শহর রূপান্তরিত হতে হতে হারাতে বসেছে ঐতিহ্য আর জৌলুস।
২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৫৩.৪ বর্গকিলোমিটার। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১সালে। এরপর কেটে গেছে একযুগ। স্বাচ্ছন্দময় নাগরিক জীবনের জন্য এই কর্পোরেশন এখনও গ্রহণ করেনি দীর্ঘমেয়াদি কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা। শৃংখলা না থাকায় বাড়ছে যানজট। ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থা, নিরাপদ পানীয়ের অভাব, মশার উৎপাতে নাগরিক ভোগান্তি চরমে।
এলাকাবাসী বলেন, 'ড্রেনেজ না থাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। স্কুলের সামনে বাচ্চাদের চলাফেরার সমস্যা হচ্ছে। আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় আধা ঘণ্টায় হাটু পানি হয়ে যায়।'
২ লাখ ৪২হাজার ভোটারের এই নগরীতে বসবাস করেন অন্তত ১০ লাখ মানুষ। মহাসড়ক লাগোয়া কুমিল্লায় বাড়তি জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। নগরীতে ভবনের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের বেশি। আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ছে নগরীতে। কিন্তু সরু রাস্তা, খাল ডোবা ভরাট হয়ে যাওয়া, পার্ক ও খেলার মাঠ না থাকায় ঐতিহ্যের এ শহরে ছন্দ হারাচ্ছে নাগরিক জীবন।
কুমিল্লার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, 'পরিকল্পনা মাফিক যদি কাজ না করা হয় আমরা যতই কথা বলি; সে নিউজ নিউজই থেকে যাবে আমাদের কথাও থেকে যাবে। '
ভাষা সৈনিক অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, 'আগামী দিনের বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর স্মাট সিটি কর্পোরেশন প্রত্যাশা করছি।'
শব্দদূষণে বিপন্ন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, বাতাসে বাড়ছে কার্বন, সিসার মত টক্সিক পদার্থ। ফলে দেখা দিচ্ছে নানা রোগের উপসর্গ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, 'মডার্ন বর্জ্য ব্যবস্থা করবেন। এরজন্য কি লাগবে তা এলজিইডি, মন্ত্রণালয় চাইতে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে দেওয়ার মতো লোক নেই।'
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ফেলো সুমাইয়া বিনতে হোসাইনী বলেন, 'আমাদের শিশুদের, বয়স্ক মানুষদের নিরাপত্তার অভাব, সুন্দর একটা বিনোদন কেন্দ্রের অভাব, এই সবগুলো সমস্যা সমাধানে প্রথমেই আমাদের যেটা করতে হবে তা হচ্ছে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।'
নগরীর দক্ষিণে ৬টি ওয়ার্ড শুরু থেকে কর্পোরেশনে যুক্ত হলেও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা।
গ্রামীণ মানুষরা অভিযোগ করেন, 'সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন যদি থাকতো তাহলে পানি দ্রুত নিষ্কাশন হয়ে যেত। খাবারের পানির অনেক সংকট।'
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার পরামর্শ নগরায়ন বিশ্লেষকদের।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, 'পরিকল্পিত নগরবিদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সিটি কর্পোরেশন কাজগুলো করবে। বিশেষ করে পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিবহনের শৃঙ্খলা।'
বছর বছর খাজনা দিলেও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের দক্ষিণের বাসিন্দারা বঞ্চিত সিটি কর্পোরেশনের সুযোগ সুবিধা থেকে। এখনো তাদের গ্রামীণ জীবনযাপন। প্রত্যাশা করছে তাদের ভোটে র্নিবাচিত নতুন জনপ্রতিনিধি তাদের সমস্যাগুলো দূর করবেন।