১৯৭১ এর গণমানুষের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান

বিশেষ প্রতিবেদন
দেশে এখন
0

১৯৭১ এ যে সাম্যের জন্য এদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। ইতিহাস বিশ্লেষক বদরুদ্দীন ওমর বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণমানুষের অধিকার প্রশ্নে আমূল পরিবর্তন না হওয়াই প্রমাণ করে, মুক্তির জন্য লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু ২৪ এর এই গণবিপ্লবও কি বেহাত হবার শঙ্কা আছে? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বীর প্রতীক ফারুক-ই আজম বলছেন, ১৯৭১ এর পর ২৪ এমন এক ভিত্তি- যা ভবিষ্যতে কোনো পক্ষের এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বিজয় একাত্তর হলের এই রিডিং রুম জসিমউদ্দিনের কাছে নতুন নয়। কিন্তু ১৮ জুলাইয়ের পর, গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দেড় হাজার শহীদ পরিবার ও ২২ হাজার আহতের মতই তার কাছে পাল্টে গেছে তার আশপাশের অনেক কিছুই।

দেখতে স্বাভাবিক মনে হলেও, জসিমের একপাশের দৃষ্টি ঐ তারিখের পর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জুলাই আন্দোলনে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলির স্প্লিন্টার ঢুকে আছে, তার বাম চোখে, রেটিনার খুব গভীরে। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছেন, এতে দৃষ্টি ফিরবে না আর, যত্ন নিন ডান চোখের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা, চাকরিপ্রার্থী এই তরুণ প্রাথমিক পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস লিখিত পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু রক্ত লাল জুলাই, অপরিমাণদর্শী করেছিল, তাকেও। ফল, গতির জীবনের পরিবর্তে এই সতর্ক পদভার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জসিমউদ্দিন খান বলেন, ‘আমি লিখতে গেলে কলম আধা ইঞ্চি পাশে পরে। মানে আমি কোথায় কলম ফেলবো তা শনাক্ত করতে পারি না। এ কারণে আমি এখনো আমার লেখাটা ইজি করতে পারি নি। আর পড়তে গেলে পাঁচ-দশ মিনিট পর প্রচণ্ড ব্যথা হয়। খারাপ লাগার বিষয় হচ্ছে একই সাথে যাদের সঙ্গে চাকরির আবেদন করেছি পরীক্ষা দিয়েছে তারা এখন পরীক্ষা দিচ্ছে, ভাইভা দিচ্ছে। ওই একই আবেদন করা চাকরির পরীক্ষায় আমি বসতেই পারছি না। আমি একই সঙ্গে আমার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশায়।’

এই ভূখণ্ডের মানুষের অধিকার কিংবা মুক্তির জন্য সংগ্রাম নতুন নয়। আজ থেকে ৫ দশক আগে, ৭১-এ মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিলো, তাতে মূলমন্ত্র ছিল, এই সাম্য, মানবিক মর্যাদা কিংবা সুশাসনের জন্য লড়াই। কিন্তু সেই ঘটনার ৫৩ বছর পর, ২৪ এ এসে একটা স্বাধীন দেশেই এই দেশের মানুষের জীবন দিতে হয়েছে, একই বৈষম্যের বিলোপ আর স্বৈরাচার রুখে দেবার আন্দোলনে।

এই ইতিহাস বিশ্লেষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ২৪ এর অভ্যুত্থান পরবর্তী স্বাধীনতা শব্দটি তার কাছে কেমন, সেই মূল্যায়ন নিয়েই।

প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন ওমর বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময় তো আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ ছিল না। যাই হোক তাদের তাড়িয়ে দেয়ার পর সেসব গল্প আর হবে না। এখন যেটা হতে পারে এই স্বাধীনতা দিবসে, যে আসলে ৭১ সালে কি হয়েছিল, জনগণের কী ভূমিকা ছিল ইত্যাদি। এর বড় অর্জন হচ্ছে যেভাবে নির্যাতন হয়েছে, ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক দলই আসুক তারা নির্যাতনকে ওই পর্যায়ে নিতে পারবে না। বাকি সব ঠিক থাকবে।’

তাহলে কি, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, এ তটের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের শেষ বিন্দু?

প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন ওমর বলেন, ‘হাসিনা পালিয়েছে, তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশ থেকে তো ব্যবসায়ীরা চলে যায় নি। যে শাসক গোষ্ঠী শাসন করে এসেছে তারা। বর্তমান অস্থায়ী সরকার বা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার তো তাদের বাদ দিয়ে চলতে পারবে না। জনগণের মূল যে প্রয়োজন সেগুলো তো আছে। কাজেই যে বড় আকাঙ্ক্ষা সামনের কোনো সরকার পূরণ করতে পারবে। এ সরকারের তো সম্ভবই না। কারণ এদের কোনো ক্ষমতা নাই। কিন্তু জনগণের লড়াই চলবে। এ লড়াই কারো পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

এটা ঠিক, অভ্যুত্থানের ৭ মাস পরও অনিয়ম দুর্নীতি, নানা ক্ষেত্রে ভোগান্তি কিংবা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্রে যে আবার রং লাগছে নতুনভাবে, সেটা অস্বীকার করার নয়।

বীরপ্রতীক ফারুকী আজম, যিনি বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তরণের জন্য ২৪ যদি বিরাট সুযোগ হয়, সেটা কাজে লাগাতে সরকারের দুর্বলতা কেন?

ফারুক ই আজম বলেন, ‘বদ্ধ জলাশয় থেকে যখন বাঁধ ছেড়ে যায়, দূষিত পানি বের হয়ে যায়, আমি মনে করি স্বচ্ছ সলিল ধারা আসবে, আসছে। দীর্ঘদিন ধরে একটা স্বৈর ব্যব্স্থা প্রশাসনিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চলে আসছে। সেগুলোকে আবার পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা বিপত্তি তো আছেই। আমরা মনে করছি মানুষের আকাঙ্ক্ষা যখন প্রবল ভালো দেশ পাওয়ার, ভালো সমাজ পাওয়ার আমরা মনে করি সেগুলো অতিক্রম করতে পারবো। শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

এই মুক্তিযোদ্ধার কথায় এটা স্পষ্ট, ২০২৪ সালের এই গণঅভ্যুত্থান ১৯৭১ এর গণমানুষের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। পাশাপাশি এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক ভিত্তি যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কোনো পক্ষের। এই সংগ্রামের ঢেউ থেকে দেশের সমাজ-রাজনীতিতে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে উত্থান তার গন্তব্য, এই জাতির কাঙ্ক্ষিত মুক্তির মোহনা, যোগ করেন তিনি।

এএইচ