১৯৭১, শোষণ আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ পূর্ববাংলা। পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়েছিল আপামর ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক।
সার্বভৌমত্ব রক্ষার রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে রসদ জুগিয়েছিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গড়ে ওঠা অস্থায়ী সরকার। জাতীয় চার নেতার হাতে পরিচালিত এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে রেখেছিল চাঙ্গা।
একাত্তরের ২৬ মার্চ, শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব। পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবর্তমানে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব আসে তাজউদ্দিন আহমেদের কাঁধে। মুক্তিকামী বাঙালির রণাঙ্গনের কৌশল ঠিক করা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জমান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।
তবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন ভূখণ্ডের সম্মুখ নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিব। তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে বিবেচিত জাতীয় চার নেতা ধীরে ধীরে হতে থাকেন উপেক্ষিত। বঞ্চিত হন রাজনৈতিক মূল্যায়ন থেকে।
৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মম হত্যাযজ্ঞের নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গর্জে ওঠে ঘাতকের রাইফেল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
শহীদ পরিবারের সন্তানদের অভিযোগ, মহান মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে উপেক্ষিত থেকেছেন জাতীয় চার নেতা। পাননি আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন।
জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ বলেন, ‘১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের পরিবারের হাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বলিদান হয়ে যায়। কারণ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে কখনই তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাননি। চার নেতার কাছে জানতে চাননি যে তোমরা কীভাবে দেশ স্বাধীন করলে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে যারা ছিল তাদেরকে সাইডলাইন করে দেয়া হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেলহত্যার মধ্যদিয়ে জাতীয় নেতৃত্বকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের অবমূল্যায়নই ফ্যাসিজমের পথ মসৃণ করেছে।
কবি, প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে শেখ মুজিবকে দানব আকারে বানানো হয়। যার কারণে আমাদেরকে আবার দ্বিতীয়বার এত রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করতে হলো।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে পরিবারতন্ত্রেই আবদ্ধ থাকে আওয়ামী লীগ। নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে নেয়নি কোন উদ্যোগ। তাই পাঠ্যসূচিতে জাতীয় চার নেতার অবদান যুক্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে জেলহত্যা দিবস পালনের দাবি এই শহীদ সন্তানের।
জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ বলেন, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হাইজ্যাক হয়ে যায়। একজনের ইতিহাস তারা বার বার কেন তুলছে কারণ মুক্তিযুদ্ধের অন্য লিডারদের কথা কেউ জানতে না পারে। যেই সরকারই আসে তাদের হাতে ইতিহাস বন্দী হয়ে যায়। ব্যক্তি স্বার্থ মতো ইতিহাসকে কাটা ছেড়া করেন।’
স্বাধীনতার অংশীদার হিসেবে শেখ মুজিবকে একক কৃতিত্ব নয়, বরং জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক মূল্যায়নের গুরুত্ব তুলে ধরেন এই বিশ্লেষক।
কবি, প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘তথাকথিত চেতনা যেটা আওয়ামী লীগ বলে তার বাহিরে গণ চেতনা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যারা জেল হত্যার সাথে জড়িত তাদের শাস্তি হোক।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে রাষ্ট্রকে। দলীয় বা ব্যক্তি যে স্বার্থেই ব্যবহার কোন সুফল বয়ে আনবে না আর তার চেষ্টা হলেও, তারুণ্য ঠিকই খুঁজে নেবে সঠিক ইতিহাস।