রাজধানীর তাঁতীবাজার, দেশের স্বর্ণের বাজারের গোড়াপত্তন এখান থেকেই। এখানেই দেখা মিলবে গহনা তৈরির অসংখ্য কারখানা, যাকে ঘিরে হাজারো কারিগরের জীবন-জীবিকা।
কেমন আছেন, এখানকার গহনা কারিগররা? এক কক্ষের কারখানাটিতে কাজে ব্যস্ত ১৫ থেকে ২০ জন গহনা শিল্পী। যাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে রূপ পায় বাহারি অলঙ্কার। আভিজাত্য ফুটে ওঠে স্বর্ণের নকশায়। তবে গহনায় উজ্জলতা আনা এই মানুষগুলোর সাদামাটা জীবনে বদল আসে না খুব একটা।
স্বর্ণের কারিগর শ্যামল দাস, প্রায় ২৭ বছর ধরে সখ্যতা গহনার সঙ্গে। নানান নকশায় গহনাকে করেছেন সৌন্দর্যমন্ডিত। কিন্তু তার জীবনে সৌন্দর্য এসেছে কি?
তিনি বলেন, ‘কাজ করে আমাদের দিন চলে, এই আর কী। মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হলেও এরমাঝে খরচাও আছে।’
তার মতো অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে গহনা তৈরির কাজ করছেন। অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণের অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে অলঙ্কার। সূক্ষ্ম এই কাজ করতে গিয়ে অনেকেই শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। দীর্ঘ সময় বসে থেকে কোমর-ঘাড় ব্যথ্যাসহ ভুগছেন চোখের সমস্যায়।
কারিগররা বলেন, ‘অপরিষ্কার পরিবেশে আমাদের কাজ করতে হয়। অনেকদিন ধরে কাজ করি তো, চোখেও কম দেখি। দূরের জিনিস দেখতে পারলেও আমরা কাছে দেখতে পারি না।’
গহনা শিল্পীদের নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামো নেই। স্বর্ণ তৈরির ওয়েস্টেজ হিসেবে ধরে যতো ভরি স্বর্ণের অলঙ্কার তৈরি করতে পারবেন তার ওপর ভিত্তি করেই পান মজুরি। সেক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে দুই আনা স্বর্ণ পর্যন্ত মজুরি পান তারা, যা দিয়ে মূল্যস্ফীতির বাজারে খুব একটা ভালো নেই কারিগররা।
জুয়েলারি উৎপাদনে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখনো পুরনো নিয়মে, সরঞ্জামেই চলছে স্বর্ণ গলানোর কাজ, যাকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের কাজে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় পড়ছেন স্বর্ণ কারিগররা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘অনেকসময় তারা চোখে প্রতিরক্ষামূলক কোনকিছু ব্যবহার করেন না। এ কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তিও কমে যাচ্ছে।’
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্বর্ণ কারিগরদের কাজ উন্নতমানের। তবে আধুনিক ল্যাব বা সুষ্ঠু কাজের পরিবেশের অভাবে অনেকে পেশা বদল করছেন। তাই এই শিল্পের প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি তাদের।
স্বর্ণ ব্যবসায়ী ফরিদা হোসেন বলেন, ‘কারিগরদের সুন্দর পরিবেশে কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কেননা দিন দিন স্বর্ণের কারিগররা পেশা বদল করছেন।’
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির হিসাব বলছে, দেশে গহনা শিল্পীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তবে যথার্থ মূল্যায়নের অভাবে অনেকেই এই পেশা থেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন। মান ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে উন্নত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আধুনিকায়নের উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি সংগঠনটির।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহ-সভাপতি রিপনুল হাসান বলেন, আস্তে আস্তে টেকনোলজি চলে আসছে। কারিগররা ভালো কাজ করেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তাদের দক্ষতা আরও বৃদ্ধি পাবে।’