বাণিজ্যের ইতিহাস

সিল্ক রুট: চার হাজার মাইলের কঠিন পথ পেরিয়ে রোম যেত চীনা পণ্য

দুই মহাদেশকে যুক্ত করেছিল প্রাচীন সিল্ক রুট

বর্তমান পৃথিবীকে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ। চাইলেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যাওয়া খুব সহজ। এই যে পৃথিবীর এতো উন্নত যোগাযোগ তা কী একদিনে হয়েছে? না। মূলত বাণিজ্যের প্রয়োজনেই গড়ে ওঠেছে নগর, সভ্যতা আর এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের যোগাযোগ। ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই উন্নত আর আধুনিক সংযোগ।

এই ধরুন বর্তমানে কয়েক ঘণ্টায় এশিয়া থেকে ইউরোপে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু একসময় এই যাত্রায় মাসের পর মাস সময় লেগে যেতো। বলছি সিল্ক রোডের কথা। ইতিহাসের বাণিজ্যে এই রুটের আছে অসামান্য অবদান। এই একটি রুটের মাধ্যমে আজকের চীনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ইউরোপ। সেইসঙ্গে যুক্ত ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশ। বাণিজ্যের ইতিহাসের প্রথম পর্বে চলুন জেনে নেই সিল্ক রোডের বিস্তারিত।

হাজার হাজার বছর পুরনো এই রোডের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিল্ক বা রেশম কাপড়। এই কাপড় ঘিরে ইউরোপের সঙ্গে গড়ে ওঠেছিল এশিয়ার বিশেষ করে চীনের বাণিজ্য। রাজকীয় পোশাকের এই কাপড় ছিল ইউরোপীয়দের খুবই পছন্দের। তাই সিল্ক রোডের প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য ছিল চীনের রেশম কাপড়। তবে এই যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার কয়েকশ বছর পর নামকরণ হয় এই রোডের। ১৮৭৭ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ ও পর্যটক ফার্ডিন্যান্ড ভন রিথোফেন এর নাম দিয়েছিলেন ‘সিল্ক রুট’ যা সিল্ক রোড নামেও পরিচিত।

ইতিহাস

মূলত প্রাচীনকালের অন্যতম বড় দুই সভ্যতা চীন ও রোমের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য গড়ে ওঠেছিল এই রুট। তবে শুধুমাত্র একটি রাস্তা নিয়ে সিল্ক রোড গড়ে ওঠেনি। অনেকগুলো সড়ক বিভিন্ন জায়গায় মিলিত হয়ে গড়ে ওঠে এই রুট। ছিল সমুদ্রপথও। ১৫ শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি বাণিজ্যের রুট হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ সালে চীনের হান সাম্রাজ্যের সময় থেকে এই রুটে বাণিজ্য শুরু হয়। চলে খ্রিস্টাব্দ ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত। অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে চীনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে এই রুটের বাণিজ্যে ভাটা পড়ে।

সিল্ক রুট

এই রোডের বাণিজ্য পথ হিসেবে এখন আমরা যে রুটগুলো জানি, একেবারে শুরুতে কিন্তু এটি এমন ছিল না। হান সাম্রাজ্যের সময়ে শুধুমাত্র চীনের অভ্যন্তরে সিল্ক বা রেশম পণ্যের বেচাকেনার জন্য একটি রুট তৈরি হয়। তবে মধ্যচীন থেকে দেশটির পশ্চিমে সহজে পণ্য পরিবহনের জন্য পারস্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন হান সম্রাট। যার মাধ্যমে রয়্যাল রোডের সঙ্গে যুক্ত হয় চীনের ওই রুট। সেইসঙ্গে পশ্চিমাদের সঙ্গেও বাণিজ্য বাড়ায় চীন।

এদিকে হান সাম্রাজ্যেরও ৩০০ বছর আগে তৎকালীন পারস্য আর বর্তমান ইরানে দ্য রয়্যাল রোডের যাত্রা শুরু হয়। ইরান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত এই সড়কের মূল বাণিজ্য পথ ছিল ২০০০ মাইল বিস্তৃত। সেসময় এই রুটের সঙ্গে ছোট ছোট রাস্তাও যুক্ত হয় যা ভারতীয় উপমহাদেশ ও উত্তর আফ্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিল।

অন্যদিকে রয়্যাল রোডের মাধ্যমে সিল্ক রুট ক্রমে মধ্য এশিয়ার অনেক রাজ্যের সঙ্গে মিলে যায়। প্রবেশ করে ভারতেও।

নিরাপত্তা

সিল্ক রোড ৬ হাজার ৪শ ৩৭ কিলোমিটার বা চার হাজার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এশিয়ার সবচেয়ে বড় গোবি মরুভূমি ও পামির পর্বতসহ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জনপদ দিয়ে ছিল এই রোডের যাত্রা। তবে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করতে হতো সেসময়কার বণিকদের।

এর রক্ষণাবেক্ষণ কোনো সরকার বা রাজ্যের অধীনে না থাকায় সড়কের অবস্থাও ছিল বেহাল। কোথাও পাথুরে ও রুক্ষ মরুভূমি, কোথায় আবার বালুময় পথ। তাই এই পথে যাতায়াতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল খাবার পানির সন্ধান। ব্যবসায়ীদের শুধু নিজেদের জন্য নয়, তাদের চলাচলের বাহন উটের জন্যও পানির সন্ধান করতে হতো।

তবে সময়ের সঙ্গে এই সমস্যার সমাধান হতে থাকে। এই বণিকদের খাদ্য, পানি ও বিশ্রামের ব্যবস্থার জন্য ধীরে ধীরে সরাইখানা চালু হয়। ক্লান্ত বণিকদের জন্য সেখানে রাতে ঘুমানোরও ব্যবস্থা হয়।

এই রুটে চলাচলের আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ডাকাতের হামলা। জনবসতি না থাকায় বেশিরভাগ এলাকা ছিল ডাকাতদের দখলে। তাই বণিকদের জন্য ডাকাতের হামলা ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। ডাকাতের কবলে পড়লে মূল্যবান মালামাল তো বটেই, হারাতে হতো প্রাণও। নিজেদের রক্ষা করতে ব্যবসায়ীরা কাফেলা করে একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। তাদের চলাচলের প্রধান বাহন ছিল উট। তবে, অন্যান্য প্রাণীও বাহন হিসেবে ব্যবহার হতো।

এদিকে এই সিল্ক রোডের আওতায় ছিল সমুদ্রপথও। ভারতীয় উপমহাদেশ, আরবের উপদ্বীপ ও আফ্রিকার পাশ দিয়ে এই জলপথের যাত্রাও সহজ ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ছিল জলদস্যু আতঙ্ক।

পণ্য

আগেই বলছিলাম, সিল্ক রোডের প্রধান পণ্য ছিল রেশম। তবে এর বাইরেও নানা ধরনের পণ্য বাণিজ্য হতো এই পথে। রেশমের পরই সবচেয়ে বেশি যে পণ্য ইউরোপে যেতো তা হলো চীনে আবিস্কার হওয়া কাগজ ও বারুদ। এছাড়াও ছিল মসলা, শস্য, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, চিত্রকর্ম, পাথর, ধাতু ইত্যাদি। সেইসঙ্গে সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নেও ছিল এর অসামান্য অবদান। শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, শিক্ষা ও ধর্মের বিনিময় হয়েছিল এই রোডের মাধ্যমেই।

বর্তমান সিল্ক রোড

পুরনো এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাণিজ্যের নতুন দ্বার হতে চলেছে। জল, স্থল ও রেলপথে এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ২০১৩ সালে নতুন সিল্ক রোড প্রকল্প হাতে নেয় চীন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে ৬৫ টি দেশের সড়ক, রেল ও বন্দর উন্নয়ন করবে চীন। যে রুটে বা বালুকাবেলায় একসময় উটের কাফেলা ধুলো উড়িয়ে যেত সেখানে এখন চলাচল করবে দ্রুতগতির মোটরযান।

এসএসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর  

No Article Found!