এই ছবিটি ১৯৭৪ সালের। ব্রিটিশ সাংবাদিক জোনাথন ডিম্বলবি, যখন দেশজুড়ে চলা দুর্ভিক্ষের চিত্রধারণ করছিলেন, তখন এভাবেই তার কাছে খাবারের জন্য আকুতি করছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষেরা।
সরকারিভাবেই স্বীকার করা হয়েছিলো, সেই দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মারা গেছেন ২৭ হাজারের বেশি মানুষের মানুষ, বেসরকারি হিসেবে সে সংখ্যাটি ছিলো ১ লাখের বেশি।
এই দুর্ভিক্ষের পরের বছরই দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা; বাকশাল প্রবর্তন করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় পত্রিকাগুলো, নিষিদ্ধ করা হয় সকল রাজনৈতিক দল। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন।
যে নির্বাচন নিয়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইয়ের বর্ণনা, ‘তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যিনি ইংরেজি থেকে বাংলায় বাংলাদেশের সংবিধানের অনুবাদ করেছিলেন, সেই প্রফেসর আনিসুজ্জামান যাচ্ছেন ভোট দিতে। দুই গাড়ি ভরে তিনি সহকর্মীদের সাথে ভোটকেন্দ্রে গেলেন। সাথে উপাচার্য অধ্যাপক ইন্নাস আলী, রেজিস্টার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী। সকলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সম্মানিত শিক্ষক এবং সাধারণ্যে অতি পরিচিত মুখ। সকলের মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে তাঁদের সেই উত্তুঙ্গ উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। তারা জানলেন, তাদের সকলের ভোটই দেয়া হয়ে গেছে।’’
রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘স্বাধীন একটা দেশে কিছু সমস্যা থাকে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটে। কিন্তু এখানে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টাই ছিল না। সমস্ত জায়গায় রক্ষীবাহিনীরা গ্রামের ছেলেদের মেরে ফেলছে, ঢাকায় আওয়ামী লীগের লোকরা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করছে, এই যে একটা পরিস্থিতি একদিকে আরেকদিকে হচ্ছে দুর্ভিক্ষ চলে এসেছে।’
তিনি বলেন, না খেতে পেরে রাস্তায় মানুষ মরে আছে। সমস্ত গ্রাম থেকে অনেক পরিবার ঢাকায় চলে এসেছে।’
এই বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের ঐরকম একটা নাজুক পরিস্থিতি এবং তার মধ্যে নেয়া এক নায়ক সিদ্ধান্তগুলোই সে সময় মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু এইসব ঘটনা ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত? যখন ঐ বছরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়?
এ বিশ্লেষক বলেন, মানুষ একটা পরিবর্তন চাচ্ছিল। যে পরিবর্তনে ৭৫ এ শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। বেশি হয়েছে বা কম হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। কথা হচ্ছে ওটা একটা বহিঃপ্রকাশ। এরপর আসলো ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের ক্যু প্রচেষ্টা। কিছুটা সফল ছিল, কয়েকদিন এমন ছিল। তারপর ৭ নভেম্বরে এখন তো ছাত্র-জনতা তখন ছিল সিপাহী জনতা তাদের একটা ক্যু। ওইটা দিয়ে একটা পরিবর্তন আসলো মানুষ সেটা স্বাগত করলো। ২০২৪ সালেও একই জিনিস। ১৫ বছরের দুঃসহ একটা শাসন। কিন্তু দুটোই কিন্তু যেমন ৭৫ এর ঘটনা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ২৪ সালের টাও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’
বস্তুত ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশে যেসব সংকট ছিলো, পরবর্তী ৩ মাসে সেসব সংকটের যে সমাধান হয়েছিলো তা বলা যায় না। মূলত তখনও সেনানিবাসগুলোতে ছিলো চাপা উত্তেজনা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশ পাল্টা যে অভ্যুত্থান ঘটায়, যেটি ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলো বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এবং এই অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কেন্দ্রে চলে আসার কারণ হিসাবে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তার পেশাদারিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া সহ, সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাকে মনে করেন এ বিশ্লেষক।
এই দুই বিশ্লেষকই মনে করেন, যদিও ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে শুরু করে কিন্তু সব মিলিয়ে এর মাধ্যমে রাজনীতিতে নতুন ধারার একটা যাত্রা শুরু হয়েছিলো, যেটা মানুষকে আশ্বস্তও করেছিলো।
কিন্তু এই বিপ্লবের অন্যতম ভূমিকা পালন করা চরিত্র কর্নেল তাহের, ক্রাচের কর্নেল বইতে যাকে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার প্রাণ রক্ষার কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে, তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
সব মিলিয়ে এই দুই বিশ্লেষক, ৭৫ এর ৭ নভেম্বর এবং ২৪ এর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গণমানুষের প্রতিবাদের ছবিকে অনেকটা একই রঙে আঁকতে চেয়েছেন।
তবে সেনবাহিনীর নেতৃত্ব যে এই দুই বিপ্লবকে পার্থক্য করে দিয়েছে বিষয়েও একমত তারা। তারা মনে করেন, ভিন্ন এই রঙটি এই অভ্যুত্থানকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে।