বিশ্ব অর্থনীতি
অর্থনীতি

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি

আফগানিস্তান ২০২১ সালে যখন তালেবানদের দখলে যায়, তখন আবারও সেই ২০ বছর আগের ভয়াবহ জীবনের হাতছানি দিচ্ছিলো দেশটির সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে নারীশিক্ষা ও মানবাধিকারে তালেবান শাসন নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। তবে মাত্র আড়াই বছরে অর্থনীতিতে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে দেশটি। ক্ষমতা দখলের একবছরের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি অর্ধেকে নেমে আসে। রপ্তানি আয় ও রাজস্ব আদায়েও চমক দেখাচ্ছে তালেবান সরকার। সেইসঙ্গে কৃষি খাতে আছে অভাবনীয় সাফল্য। এতো কম সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির এই উত্থানের পেছনে কী আছে?

দুই দশকের যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের সেনাদের হটিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে তালেবানরা। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেই বছর দেশটির জিডিপি ২০.৭ শতাংশ সংকুচিত হয়। যা ২০২২ সালের প্রথমদিকে আরও ৬.২ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়। তবে জিডিপির এই সংকোচন ওই বছরের মাঝামাঝি থেকে কমতে শুরু করে।

বলা হয়, সংঘাত কমে যাওয়া, বন্ধ হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা আবারও শুরু হওয়া, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতির দমন। অভ্যন্তরীণ আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে যা জিডিপিতে ১৫ শতাংশ যোগ করে, যদিও তা ২০১৯ সালের চেয়ে ৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম। স্ট্যাটিস্টা’র তথ্যমতে ২০২১ সালে জিডিপি ছিল ১৪.২৯ যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০২২ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতি যেখানে ১৮.৩ শতাংশ ছিল, নভেম্বর হতেই তা নেমে আসে ৯.১ শতাংশে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পর রপ্তানি আয় ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার। দু’বছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১.৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২২ সালের ২২ মার্চ থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করে ১৫৪ কোটি ডলার।

ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের অর্থনীতি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অনেকটা শূন্য কোষাগার নিয়ে শুরু হয় এই সরকারের যাত্রা। কারণ তালেবানরা কাবুলে পৌঁছার আগেই দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ নিয়ে পালিয়ে যান তাজাকিস্তানে। অন্যদিকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে থাকা প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার আটকে রাখা হয়। ধস নামে ত্রাণ ও আন্তর্জাতিক সাহায্যনির্ভর অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও।

দেশটির ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে শুরু করে তালেবানরা গ্রহণ করে এমন সব অপ্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি যা অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোর সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা অনেকটা অসম্ভব।

কঠোর হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে তালেবান সরকার। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বের যেসব দেশের মুদ্রা সবচেয়ে ভালো করেছে তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানি। অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে তাদের প্রথম পদক্ষেপই ছিল স্থানীয় লেনদেনে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার বন্ধ।

পাশাপাশি দেশ থেকে বাইরে ডলার নিয়ে যাওয়ার ওপরও কড়াকড়ি আরোপ করে তালেবান সরকার। এছাড়াও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য অবৈধ ঘোষণা করে তারা। প্রবাসীদের আয় বৃদ্ধির জন্যও নেয় নানা উদ্যোগ।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তথাকথিত ডুরান্ড লাইন নামে অরক্ষিত সীমান্তের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশটিতে ব্যাপকহারে ডলার পাচার হয়। আর এই পাচার হওয়া ডলারও গতি সঞ্চার করছে আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে।

এছাড়া আফগানিস্তানের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রণ হয় দেশটির মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর হাতে যারা সরাফ নামে পরিচিত। সরাফদের কাছে প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা হাতবদল হয়। আর এই বাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই বলে জানানো হয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে।

একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য, কৃষি হতে পারে প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মূল চালিকাশক্তি, যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশটি নতুন করে গড়ে তুলতে ইমারাতে ইসলামিয়া প্রশাসন কৃষি খাতের উন্নয়নেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে, আফিমসহ সকল মাদকদ্রব্য চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

যদিও এ পদক্ষেপে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তহবিল পাওয়ার কৌশল হিসেবে উদ্যোগ নিয়েছিল দেশটি কিন্তু বর্তমানে এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

তালেবান নিষেধাজ্ঞার পর আফিম চাষ কমে গেছে ৯৫ শতাংশ। মাদকের পরিবর্তে জাফরান ও গম চাষে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেন তারা। এতে তারা সফলও হয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম দামি মসলা জাফরান চাষকারী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ এখন আফগানিস্তান।

আফগান জাফরান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মোহাম্মদ ইব্রাহিম আদেল বলেন, 'গেল আট মাসে ভারত, স্পেন এবং সৌদি আরবের মতো দেশে প্রায় ৩০ হাজার কিলো জাফরান রপ্তানি করা হয়েছে।'

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাফরান উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান চলতি বছরে প্রায় ৫০ টন জাফরান সংগ্রহ করবে বলে আশা করছে। এছাড়াও ডালিম চাষ আফগানিস্তানের অন্যতম কৃষিপণ্য।

দেশটি যেসব সেক্টরে উন্নতি লাভ করেছে তার মধ্যে জুস ও কোমল পানীয় অন্যতম। পামির কোলা শাফা নামে এক কোমল পানীয়র প্রোডাক্ট উম্মোচন করা হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকায় তা রপ্তানি হচ্ছে। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রয়যোগ্য কোকাকোলার বিকল্প এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে ধরা হয়েছে।

বলা হয়, লিথিয়ামের ওপর ভাসছে আফগানিস্তান। দেশটির মাটির নিচে থাকা উত্তোলনযোগ্য লিথিয়ামের সম্পদমূল্য বর্তমান বাজার অনুযায়ী তিন ট্রিলিয়ন ডলার বা তিন লাখ কোটি ডলার। তালেবান সরকার কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পেলেও এই ইস্যুতে কাজ করছে পরাশক্তি চীনের সাথে।

বর্তমানে ২০টির বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানে কাজ করছে এবং শতাধিক চীনা কোম্পানি দেশটির খনিতে কাজ করার জন্য আফগানিস্তানের খনি মন্ত্রণালয়ে তাদের নামও নিবন্ধন করেছে। তালেবানরাও তাদের অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে চীনা প্রকল্পগুলোকে কার্যকর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে।

বিপুল আয়তনের জমিতে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নিজস্ব প্রযুক্তি এবং অর্থায়নে ১০৮ মিটার প্রস্থ ও ২৮৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুশটেপা খাল তৈরি করছে তালেবান সরকার। এতে প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সারা বছর স্থায়ী সেচের ব্যবস্থা হবে। যদিও এই প্রকল্পের ফলাফল নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে।

অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার অভাবনীয় এইসব পদক্ষেপের সাফল্যের ফলে '২০২৩ সালে আফগান অর্থনীতি সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে' বলে পূর্বাভাস দেয় বিশ্বব্যাংক। ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলেও জানায় বিশ্বব্যাংক।

তবে ইউএনডিপির পরিচালক কান্নি উইগনারাজার মতে, বেসরকারি খাতে মূলধনের অভাব, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে নগদ অর্থ প্রবাহিত না হওয়া, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজনীয় স্তর এবং স্কেলে নেই।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির এই সম্ভাবনার পুঁজিই হলো আন্তর্জাতিক সহায়তা, ভোগ-চালিত প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাত-নেতৃত্বাধীন অর্থনীতি। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, সেচ অবকাঠামো, ভূমির মেয়াদ নিরাপত্তা, গবেষণা এবং বাজারে প্রবেশাধিকারে কৌশলগত বিনিয়োগ প্রয়োজন।

এভিএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর