দেশে এখন
0

শিশুর হাতে দেয়া প্লাস্টিকের খেলনা কতটা স্বাস্থ্যকর?

শিশুর শৈশবের খেলনার ৩৮ শতাংশই প্লাস্টিকের দখলে। বেসরকারি সংস্থা-এসডো'র গবেষণা বলছে, এসব খেলনায় আশঙ্কাজনকভাবে উপস্থিতি বাড়ছে সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিকের। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকারক পদার্থ শিশুদের শারীরিক বিকাশ ব্যাহত করছে। বিএসটিআই বলছে, উৎপাদনকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক নয়। যা নিয়ন্ত্রণে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস তাদের।

চার দেয়ালে বন্দী শিশুর সাজানো বাগান। আকাশের নীল আর মাঠের সবুজ খুব একটা চেনা নয় তাদের কাছে। প্লাস্টিকময় ঘরবন্দি শৈশব। খেলার সঙ্গী বলতে রঙ-বেরঙের প্লাস্টিকের খেলনা। যার সাথে সকাল থেকে রাত অবধি সন্ধি শিশুদের।

দুই ভাই-বোন কিয়ান ও ফাতিহার দিনও একই ফ্রেমে বন্দী। রঙিন গাড়ি, ব্যাট-বল, লেটার ব্লকেই তাদের আনন্দ খুঁজে ফেরা। তবে, আনন্দের উপকরণে মিশে আছে বিষাদের উপাদান। প্লাস্টিকের বেশিরভাগ খেলনায় মিশে আছে নানারকম ক্ষতিকর রাসায়নিক। তবে তা জানা নেই অনেক অভিভাবকেরই। জানা থাকলেও যেন নিরুপায়। কেননা আনন্দময় শৈশবের বায়না পূরণে আর কি বা করবে তারা?

একজন অভিভাবক বলেন, 'খেলনাগুলো লোভনীয়, দেখলেই বাচ্চারা কিনতে চায়। সেটা যদি একটা স্বাস্থ্যসম্মত চিন্তা করতো, বাচ্চাদের সবার খেয়াল রেখে যদি ভালো প্লাস্টিক দিয়ে করতো তাহলে ভালো হতো। আমরা আশা করি যে ভালো প্রোডাক্ট আসুস। আমরা তো মাঠ তৈরি করতে পারবো না। আমরা বাচ্চাদের হাতে খেলনা তুলে দিতে পারবো। সেই খেলনাটা ভালো স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা কোনো সংশ্লিষ্ট বিভাগের করা উচিত।'

এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো'র একটি গবেষণা বলছে, প্লস্টিকের শিশু খেলনায় আশঙ্কাজনকভাবে উপস্থিতি বাড়ছে ভারী ধাতু সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের। যা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে তাদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট কারখানায় তৈরি নিম্নমানের খেলনা তো বটেই আমদানি করা চীনা পণ্যেও মিলছে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। যা মনের অজান্তে মুখে নিয়েই ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা।

অভিভাবকরা বলছেন, সাময়িক আনন্দ আর দামে সস্তা হওয়ায় সন্তানের হাতে দেয়া হয় এসব খেলনা।

একজন অভিভাবক বলেন, 'বাচ্চারা কান্না করে বলে আমরা এগুলো নিয়ে দিতে বাধ্য। পার্কগুলোতে যদি শিশু খেলনাগুলো বাড়ানো হয়, তাহলে এসব খেলনার প্রতি ওদের আকর্ষণটা কম হবে।'

সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, দেশের খেলনা বাজারের সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশই প্লাস্টিকের দখলে। মাটির তৈরি খেলনা সামগ্রী মাত্র ১৮ শতাংশ। বাকিটা দখলে আছে কাঠ, কাপড়, লোহা, রাবার, পাট ও সিরামিক্সের। কাঠ ১৫ শতাংশ, বস্ত্র থেকে তৈরি ৯ শতাংশ, লৌহজাত খেলনা ৭ শতাংশ, রাবারের তৈরি ৬ শতাংশ, বাকী ৩ শতাংশ তৈরি হয় পাট ও সিরামিক্স দিয়ে।

২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা দু'টি গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে সীসার ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের ৪০টি খেলনা পরীক্ষা করে পাওয়া যায় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। সীসার গড় ঘনত্বের উপস্থিতি ৬৫.৮৫ পিপিএম, মার্কারি ৩০.৬ পিপিএম আর ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ ২৮.৬৫ পিপিএম।

দেশের বিভিন্ন কারখানায় বেশিরভাগ প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হচ্ছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে। নারায়ণগঞ্জের এক কারখানা ঘুরে দেখা যায়, মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যসম্মত বিধি। কী পরিমাণ রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকবে তা নিয়েও নেই কোন সচেতনতা। তাই, গবেষকরা বলছেন, প্লাস্টিকের শিশু খেলনা তৈরিতে দরকার নির্দিষ্ট নীতিমালা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, 'প্লাস্টিক পণ্যটা যে বানায় সেটা মান নিয়ন্ত্রণ করে কি না সে দিকে নজর দিতে হবে। যারা এটা ইন্ডাস্ট্রি থেকে বানিয়ে নিচ্ছে তারা এটা দিয়ে ব্যবসা করে। সেখানে তাদের কাজ করতে হবে। এটা থেকে বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে কি না, এসব বিষয় যারা বানিয়ে নিচ্ছে তাদেরই জোর দিতে হবে যে পণ্যটা কেমন হবে। তারা যদি মান নিয়ন্ত্রণ করে দেয় তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। '

এসডো মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, 'বাচ্চাদের খেলনায় যে রঙই থাকুক না কেন তা নিরাপদ হতে হবে, এই জিনিসটা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ সেটা সীসামুক্ত হতে হবে। নীতিমালা করে সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে যে খেলনায় কোনোভাবেই সীসাযুক্ত রঙ ব্যবহার করা যাবে না।'

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানহীন প্লাস্টিকের খেলনায় থাকা ক্ষতিকারক পদার্থ শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিডনি, ফুসফুসের ক্ষতি ছাড়াও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তাদের।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, 'মানহীনভাবে বস্তু তৈরি করলে তার ভেতর বিষাক্ত ধাতব পদার্থ লেড বা সীসা বা যে রঙটি দেখা দিচ্ছে যেগুলো শিশুর শরীরে প্রবেশ করে শিশুর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। এতে তার মস্তিষ্কের বিকাশ থেকে শুরু করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে দিচ্ছে।'

মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই জানায়, তাদের অধীনে সাড়ে ৪ হাজার স্ট্যান্ডার্ড থাকলেও মাত্র ২৯৯টি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক। তবে স্থানীয়ভাবে শিশু খেলনা উৎপাদনকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এর আওতাভুক্ত নয়। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যদিও, তা মোকাবিলায় ক্ষতিকর প্লাস্টিকের খেলনার উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত ও মান নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস বিএসটিআইয়ের।

বিএসটিআই পরিচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই খেলনাগুলো আমরা খুব শীঘ্রই মানসম্পন্ন এর আওতাভুক্ত করবো। বাচ্চারা লেড, ক্রোমিয়াম বা ক্যাডমিয়ামের সংস্পর্শে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা আছে।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর শৈশবকে ফুলেল করতে যেকোনো মূল্যে কমাতে হবে প্লাস্টিকের দাপট। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব খেলনা নিশ্চিত করা গেলেই আলোকের ঝর্ণাধারায় আনন্দমেলায় ভাসবে শিশুরা।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর