দেশে এখন
নড়াইলে সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় নৌচলাচল ব্যাহত
নড়াইলের চিত্রা, নবগঙ্গা, কাজলা ও আফরা নদীতে অনুমোদন ছাড়াই কম উচ্চতার সেতু বানিয়েছে এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ। এতে চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নৌপথ ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা। সমস্যা সমাধানে কয়েকটি সেতুর কিছু অংশ ভেঙ্গে উঁচু করে নৌ চলাচল স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের।

নড়াইল-কালিয়া সড়কের নবগঙ্গা নদীর উপর বারইপাড়া সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৫১ দশমিক আট তিন মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০.২৫ মিটার প্রস্থের এই সেতুর কাজ তিনবার মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

চতুর্থবার মেয়াদ বাড়ানোর সময় সামনে আসে বড় ত্রুটি। দেখা যায় সেতুর নির্মাণ হওয়া অংশের নিচ দিয়ে যেতে পারছে না পণ্যবাহী নৌযান। এমন অবস্থায় উচু করে সেতু বানানোর জন্য নতুন নকশার অনুমোদন দেয়া হয়। যাতে খরচ বাড়ে অন্তত ৫৬ কোটি টাকা।

নবগঙ্গা নদীর উপর নির্মানাধীন সেতু। ছবি: এখন টিভি

এলাকাবাসীদের একজন বলেন, 'যে ব্রিজ করা হচ্ছে তাতে করে ব্রিজের নিচ দিয়ে কোনো কার্গো যেতে পারবে না।'

লোহাগড়ায় নবগঙ্গা, চিত্রা, কাজলা নদীসহ বিভিন্ন স্থানে ৬টি সেতু নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। যার প্রতিটি সেতু নিচু করে নির্মাণ করায় বড় নৌযান আটকে যায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

নড়াইলের চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. হাসানউজ্জামান বলেন, 'নদী পথে নিচু ব্রিজ হওয়ায় সাড়ে চারশ’ মেট্রিকটনের উপরে কোনো নৌযান এখানে আসে না।'

একই অবস্থা এলজিইডি বিভাগেরও। ২০০৮ সাল পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল, যশোরের নওয়াপাড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নদীপথে পণ্য আনা-নেয়া করতো জেলার ব্যবসায়ীরা। ওই বছর ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নড়াইলের সীমান্তবর্তী এলাকার আফরা নদীতে প্রায় চারশো ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি বিভাগ। অপরিকল্পিতভাবে নিচু সেতুটি নির্মাণে এই পথে পণ্যবাহী নৌ-যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি সেতুটির একটি অংশ ভেঙে উচু করার সিন্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যার জন্য গুনতে হবে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

ব্যবসায়ীদের একজন বলেন, 'নদী পথে পণ্য পরিবহন করলে খরচ কম হয় কিন্তু এখন সড়ক পথে পণ্য আনা নেয়া করায় খরচের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।'

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরবর্তী স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নৌপথে খুঁটিসহ বৈদ্যুতিক লাইন ও সেতু নির্মাণ করতে হলে বিআইডব্লিউটিএ'র নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। এই বিধিমালায় নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী, নদীগুলোকে চারটিভাগে ভাগ করা হয়েছে। দেশে প্রথম শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে সেতুর উচ্চতা হবে কমপক্ষে ৬০ ফুট, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪০, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ ও চতুর্থ শ্রেণির নৌপথে অন্তত ১৬ ফুট উচ্চতায় সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। 

সংস্থাটি সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে 'স্ট্যান্ডার্ড হাই ওয়াটার লেবেল' নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়। তবে, প্রজ্ঞাপন হয় ২০১০ সালে। সর্বশেষ কিছু সংশোধনী এনে ২০১৮ সালে আবারও প্রজ্ঞাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যে কোন নদীতে সেতু নির্মাণ করতে হলে বিআইডব্লিউটিএ'র ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। অথচ ২০০৪ সাল থেকে চিত্রা, নবগঙ্গা, কাজলা, আফরা নদীতে ছোট-বড় ২১টি সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি বিভাগ। যার একটিতেও নেয়া হয়নি বিআইডব্লিউটিএ'র ছাড়পত্র।

নিচু সেতুটি নির্মাণ। ছবি: এখন টিভি

নড়াইলের নদী কমিশনের সভাপতি মো. আশফাকুল হক চৌধুরি বলেন, 'ব্রিজগুলো নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএ'র ছাড়পত্র নিয়ে করা হয়নি। ব্রিজের ডিজাইন করার পূর্বেই বিআইডব্লিউটিএ'র নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স নিতে হয় কিন্তু এইসব ব্রিজে কিছুই নেয়া হয়নি।'

এমন বাস্তবতায় একদিকে সেতু ভেঙে উচু করার পরিকল্পনা চললেও অন্যদিকে নবগঙ্গা নদীর নলদী ও ভুমুরদিয়া পয়েন্টে বিআইডব্লিউটিএ'র অনুমোদন ছাড়া চলছে দুটি সেতুর নির্মাণ কাজ।

যেসব সেতুতে নৌযান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর কিছু অংশ ভেঙে উচু করার পরিকল্পনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ'র ছাড়পত্র নিয়ে সেতু নির্মাণ করতে গেলে সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ বেড়ে যায়। যাতে সরকারের অর্থেরও অপচয় হয় বলে জানিয়েছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু।

তিনি বলেন, 'দেড়শ’ মিটারের একটি ব্রিজ করতে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা লাগার কথা কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ’র যে ক্লিয়ারেন্স রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৪শ’ থেকে ৪৫০ মিটারে ব্রিজ করতে হবে এতে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা খরচ পড়ে যাবে।'

খুলনা বিআইডব্লিউটিএ'র বন্দর কর্মকর্তা মুহম্মদ মাসুদ পারভেজ বলেন, 'মহাপরিকল্পনা করে যেন সেতু নিমার্ণ করে এবং এর সাথে যারা জড়িত আছে বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড,  বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে তারপর যেন সেতু নির্মাণ করা হয়।'

২০ বছর আগেও নড়াইলের চিত্রা, নবগঙ্গা, কাজলা, আফরা নদীপথ ব্যবহার করে জেলার অন্তত ২০ হাজার ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্য আনা-নেয়া করতো। তবে, ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় বর্তমানে মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার ব্যবসায়ী ছোট নৌযান দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া করেন।

ইএ